স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সাবেক এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেন বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য এবং প্রকৌশলীদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে শতকোটি টাকা হাতিয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা মোয়াজ্জেম স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী থেকে উপজেলা প্রকৌশলী পর্যন্ত প্রায় সব গ্রেডের কর্মকর্তার বদলি-পদায়নে তদবির বাণিজ্য করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া তিনি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ঘুরে ঘুরে তদবির করতেন। বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র, পানিসম্পদ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদপ্তর এবং সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগে ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার তদবিরে নামেন।
প্রায় একই অভিযোগ উঠেছে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ছাত্র প্রতিনিধি তুহিন ফারাবি ও মো. মাহমুদের বিরুদ্ধে। তারা অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ লাভের পর থেকে চিকিৎসক, মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল, পরিচালক, উপপরিচালক, সিভিল সার্জন নিয়োগ-বদলির মাধ্যমে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এছাড়া তারা সিনিয়র স্টাফ নার্স, মিডওয়াইফ, প্যাথলজি টেকনিশিয়ান, হজ টিমে নার্স ও ডাক্তারদের নাম ঢুকানোর তদবির করেছেন বলে জানা গেছে। তাদের বিরুদ্ধ স্বাস্থ্য সেক্টরের ঠিকাদারদের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। ফারাবী ও মাহমুদ দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
অভিযোগের বিষয়ে মো. মোয়াজ্জেম হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, আমাকে অপসারণ করা হয়নি। আমি ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করেছি। আগামী মাসে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে (পিএসসি) আমার মৌখিক পরীক্ষা আছে। এছাড়া আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পরীক্ষায় ভাইভা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এসব কারণে আমি পদত্যাগ করেছি। তিনি আরও বলেন, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া রাজনীতি করবেন, তার ক্যারিয়ার আর আমার ক্যারিয়ার এক হবে না। আমি সরকারি চাকরি করব।
গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে তদবির বাণিজ্যের মাধ্যমে ৪শ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আমি এক টাকার দুর্নীতি করেছি কেউ তা প্রমাণ করতে পারবেন না। এসব ভিপি নুরের দল গণঅধিকার পরিষদের নেতারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখি করছে। আমি এক সময় গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। তাদের থেকে আলাদা হয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গঠন করায় তাদের সঙ্গে আমার বিরোধ হয়। সে কারণে তারা গুজব ছড়াচ্ছে। এসবের কোনো ভিত্তি নেই।
উপদেষ্টা নিয়োগের কিছুদিনের মধ্যে মোয়াজ্জেম হোসেনকে সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) নিয়োগ দেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। নিয়োগ লাভের পর থেকেই তদবির বাণিজ্যে নেমে পড়েন মোয়াজ্জেম। মিডিয়া এবং গণমাধ্যমের দৃষ্টি এড়াতে তারা বিকাল চারটার পর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সচিবালয় এবং সরকারি দপ্তরে অবস্থান করে তদবির করতেন। ছাত্র উপদেষ্টার এপিএস হওয়ায় বিগত সরকারের সময় থেকে কর্মরত কর্মকর্তারা ভয়ে তটস্থ ছিলেন। ফলে যে কর্মকর্তার কাছে যা দাবি করেছেন সে তা দিয়েই মোয়াজ্জেমকে খুশি করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, মোয়াজ্জেম নিজেই পুলিশ, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স, আনসার শাখায় কর্মরত কর্মকর্তাদের কাছে গিয়ে ঠিকাদারি তদবির করতেন। ওইসব সংস্থার কেনাকাটার তথ্য সংগ্রহ করতেন। অনেক অফিসার স্বেচ্ছায় তথ্য দিলেও কিছু অফিসার কৌশলে তাকে অধিদপ্তর থেকে তথ্য এবং কাজ নেওয়ার পরামর্শ দিতেন। পুলিশের জন্য অস্ত্র, গোলাবারুদ, শটগানসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনায় ঠিকাদারদের বিল পাইয়ে দেওয়ার তদবিরও করতেন মোয়াজ্জেম। গত সরকারের সময় পুলিশের বিভিন্ন সরঞ্জামাদি সরবরাহ করতেন এমন ঠিকাদাররা পালিয়ে গেলে ওই কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য যারা নতুন করে নিযুক্ত হয়েছেন তাদের কাছ থেকে কমিশন হাতিয়েছে মোয়াজ্জেম।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়েও ছিল মোয়াজ্জেমের বিচরণ। তিনি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে গিয়ে ঠিকাদারদের বিল পরিশোধের তদবির করতেন বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ আমলের ঠিকাদারদের ফেলে যাওয়া কাজ সম্পন্ন করতে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ হয়েছে, তাদের কাজ পাইয়ে দিতে তদবির করতেন মোয়াজ্জেম। গণপূর্ত অধিদপ্তরের ঠিকাদার ও প্রকৌশলী বদলির তদবির করতেন তিনি। সন্ধ্যার পর চলে যেতেন সেগুনবাগিচা গণপূর্ত অধিদপ্তরে। দীর্ঘ সময় সেখানে অবস্থান করে ঢাকা মহানগরী, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ বিভাগীয় শহর, ঢাকার নিকটবর্তী জেলাগুলোয় প্রকৌশলী বদলির তালিকা করতেন। একেকটি বদলিতে লাখ লাখ টাকা দিতে হতো তাকে। এছাড়া স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন পৌরসভার সচিব ও প্রকৌশলী, সিটি করপোরেশনে বিভিন্ন গ্রেডের কর্মকর্তা নিয়োগে বদলি বাণিজ্য করতেন এমন অভিযোগ করেছেন কর্মকর্তারা। শুধু তাই নয়, ফ্যাসিবাদের দোসর হিসাবে চিহ্নিত প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে তাদের পুনর্বাসনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন মোয়াজ্জেম-এমন অভিযোগ খোদ স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তাদের।
অন্যদিকে ৮ আগস্টের পর সাবেক স্বাস্থ্য সচিবকে দিয়ে বেশ কিছু চিকিৎসক বদলি করান তুহিন ফারাবী ও ডা. মাহমুদুল হাসান। প্রতিটি বদলিতে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা করে নিয়েছেন তারা। দুজন মিলে মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল, পরিচালক, উপপরিচালক, সিভিল সার্জন নিয়োগ-বদলিতে ১৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা আদায় করতেন। এরপর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে সিনিয়র সচিব হিসাবে নিয়োগ পান এক কর্মকর্তা। তাকেও নয়ছয় বুঝিয়ে বিপুলসংখ্যক চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী বদলি করেন তারা। এছাড়া সিনিয়র স্টাফ নার্স ও মিডওয়াইফ বদলিতে তারা দুই লাখ টাকা করে আদায় করতেন। এমনকি হজ টিমে নার্স ও ডাক্তারদের নাম ঢুকানোর জন্য টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
এছাড়া ৫ আগস্টের পর পালিয়ে যাওয়া ঠিকাদারদের স্থলে নতুন ঠিকাদার নিয়োগে তারা কমিশন বাণিজ্য করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে তুহিন ফারাবীকে অপসারণ করা হলেও মাহমুদুল হাসান এখনো বহাল তবিয়তে। সেসব টাকা রাশিয়ায় পাচার করেছেন বলে খোদ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র বলছে, মাহমুদ আগে থেকেই রাশিয়ায় বসবাস করতেন। গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর তিনি দেশে ফেরেন। তখন ফারাবী তাকে মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ পাইয়ে দেন। তিনি রাশিয়া থেকে দেশে আর নাও ফিরতে পারেন।