জাহিদ হোসেন : পূজায় তখন পুলিসের পাহারা লাগতো না। বদলীর চাকরির সুবাদে আব্বা যেখানেই যান না কেন, বিশেষ করে বিজয়া দশমীতে আলমডাঙ্গায় যেতামই। খুব মজা হতো। বন্ধুদের সাথে ‘ঠাকুর দেখে’ বেড়াতাম আর সন্ধ্যের পর বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে নানান মিষ্টান্ন ভক্ষণ চলতো। অসীম শিখিয়ে দিয়েছিল ডান হাতে ‘জলে’র গ্লাস ধরতে হয়। অন্যদের দেখাদেখি নিখুঁতভাবে প্রণামও করতাম। নারকেলের নাড়ু পেতাম প্রায় প্রতি বাড়িতেই। খেতে খেতে আর খেতে না পারলে পকেটে ভর্তি করতাম।
রতনদের বাড়িতে থাকতাম। বোধন থেকে বিসর্জন। পুরো পূজা জুড়েই ওঁদের বাড়িতে মিঠাই মণ্ডা পাওয়া যেত। রতনের মা খুব আদর করে সেসব খাওয়াতেন। এমনও হয়েছে, থালায় (আমরা তখনো প্লেট বলতে শিখিনি) ভাত তরকারি মাখিয়ে একগাল আমাকে আরেকগাল রতনকে খাইয়েছেন। আমাদের দুজনেরই বয়স তখন ১৩/১৪। উত্তমের চেহারা ছিল নন্দদুলালের মতো। তবে নন্দের মতো কৃষ্ণবর্ণের নয়; ফর্সা, নাদুস নুদুস, মায়াভরা। মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি হিসাবে ওকেই সামনে রাখতাম। ওকে দেখলে পাড়ার মা মাসিরা গ’লে যেতো। মিষ্টি কিছু ধরে দিত। আর আমি ছিলাম নীরব খাদক। পূজা ওঁদের আর মজা আমার। উত্তম, অসীম, রতন, স্বপন, লাল্টু, আমিÑ হাফপ্যান্ট পরা শিশুরা; বাড়ি বাড়ি বিজয়ার সন্ধ্যায় প্রণাম করে পকেট ভর্তি নাড়ু, সন্দেশ নিয়ে ফিরছি। মনে হয় এই তো সেদিনের কথা।
রতনের সাথে কাকিমার বাপের বাড়ি মানে রতনের নানাবাড়ি ফরিদপুরেও বেড়াতে গেছি। রতনরা নানাবাড়ি বলতো না। বলত দাদুবাড়ি। মুসলমান হিসাবে বড় কোনো পার্থক্য দেখিনি। রতনও আমাদের কুমারখালির বাসায় বেড়াতে এসেছে। হিন্দু মুসলমানের কোনো প্রকাশ্য দূরত্ব সেই শিশু বেলায় আমরা কখনো বুঝতে পারিনি।
খুব অল্প বয়সে কাকিমা মারা গেছেন। তাঁর কথা মনে হলে এক আদর্শ মাতৃমূর্তি মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। আপনারা এই যে দশভূজা দুর্গাকে দেখেন মণ্ডপে, আমার কাছে ‘মা দূর্গা’ ছিলেন তিনিই। উত্তম স্বপন চলে গেছে ভারতে। রতন অসীম লাল্টু বেঁচে নেই। কিছুই আর আগের মতো নেই। দেশটা চোখের সামনে বদলে গেছে। শিশুরা আজো আমাদের মতো বিজয়ায় বাড়ি বাড়ি যায় কি না জানি না।
তবুও আশা করি, পুলিশি পাহারা ছাড়াই একদিন আমার দেশে আবার পূজা হবে। আমাদের নিজ নিজ ধর্ম প্রতি মুহূর্তের খণ্ড খণ্ড জীবনকে এমনভাবে প্রশান্ত ও আলোকিত করবে যে, এমনকি যারা কোনো ধর্মই পালন করে না, তারাও নিশ্চিন্ত আনন্দে দিন কাটাবে। https://www.facebook.com/Zahid66
Leave feedback about this