জানুয়ারি ২২, ২০২৫
লেডিঞ্জে গ্রেন্ড, স্টকহোম,সুইডেন
মতামত

দেশে সংবিধান বিশেষজ্ঞের বাম্পার ফলন

সৈয়দ বোরহান কবীর: ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের অনেক কিছুই নতুন হচ্ছে। আমরা যেমন নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি, তেমন পেয়েছি নতুন বুদ্ধিজীবী, নতুন মাস্টারমাইন্ড, নতুন সাংবাদিক, এমন কি এক ঝাঁক নতুন সংবিধান বিশেষজ্ঞ। এতদিন তাঁরা কোথায় ছিলেন- সেই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে নিজেই চমকপ্রদ হয়ে যাই। এত বুদ্ধিজীবী, এত সংবিধান বিশেষজ্ঞ, এত প্রথিত যশা সাংবাদিকরা লোকচক্ষুর আড়ালে এতটা বছর ছিলেন কোন গুহায়?

বাংলাদেশে এখন নতুন ধারার বুদ্ধিজীবীদের বাম্পার ফলন দেখা যাচ্ছে। এই সমস্ত বুদ্ধিজীবীরা নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করছেন, নতুন দর্শন, নতুন চিন্তা চেতনা উপহার দিচ্ছেন জাতিকে। তবে এসব বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাম্পার ফলন হয়েছে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের। বাংলাদেশে এখন হাটে-মাঠে-ঘাটে সংবিধান বিশেষজ্ঞ পাওয়া যাচ্ছে। সংবিধান নিয়ে কথা বলার লোকের অভাব নেই। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে মাদ্রাসার মওলানা সবাই সংবিধান বিশেষজ্ঞ। যে যার মত করে সংবিধানের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। সংবিধান ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন। এই সংবিধান বস্তা পচাঁ- এই রকম নানা রকম ভারী ভারী বক্তব্য দিচ্ছেন। টেলিভিশন টকশোতে দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞাপন সংস্থার মালিক। শেষ কবে দুই কলম লিখেছেন তা সম্ভবত তার নিজেরই মনে নেই। কিন্ত তিনি সংবিধান বিশেষজ্ঞ। সংবিধান নিয়ে তাঁর জ্ঞান পান্ডিত্যে আমি হতবাক। আইন পড়ে কি শিখলাম। আহারে! এরকম সংবিধান বিশেষজ্ঞ থাকতে জাতির এ দশা কেমন করে হয়! শুধু সাংবাদিকরাই যে সংবিধান বিশেষজ্ঞ হিসেবে আর্বিভূত হয়েছেন বিষয়টি এরকম না। সাংস্কৃতিক জগতে যারা এটা সেটা কাটপেষ্ট করে নাটক সিনেমা করে সুশীল খাতায় নাম লিখিয়েছেন তারাও এখন সংবিধান বিশেষজ্ঞ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সোচ্চার ব্যক্তিরা সংবিধানের নানা রকম ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হচ্ছেন প্রতিদিন ইউটিউবে। একেক জন যেন সংবিধানের জটিল রহস্য আবিষ্কারকর্তা। তবে সংবিধান নিয়ে সবচেয়ে বড় বিশেষজ্ঞ হিসেবে জাতির সামনে উদ্ভাবিত হয়েছেন একজন চিন্তক কবি, যিনি বহুরূপী হিসেবে খ্যাত। তিনি নিজেকে ‘বিপ্লবের জনক’ মনে করেন। তাঁর লেখা গ্রন্থ পড়েই ‘জুলাই বিপ্লব’ সংঘটিত হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি এই বিপ্লবের পর এতটাই সরব যে এক টেলিভিশন চ্যানেল থেকে অন্য চ্যানেল যাওয়ার সময়টুকুতে তিনি কথা বলেন বিভিন্ন গণমাধ্যমের সঙ্গে। গণমাধ্যম জুড়ে এখন তাঁর উপস্থিতি দগদগে ঘাঁয়ের মত দৃশ্যমান। এই চিন্তক কবি, বুদ্ধিজীবী ‘গণঅভ্যুত্থান ও গঠন বাংলাদেশের গণ রাজনৈতিক ধারার বিকাশ প্রসঙ্গে’ এক গ্রন্থে বর্তমান সংবিধানকে নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি ওই বইয়ের ২৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন ‘বর্তমান সংবিধানের ঐতিহাসিক ন্যায্যতা যেমন নাই, তেমনি আইনি বৈধতাও নেই। এটি বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া সংবিধান। বাহাত্তরের সংবিধান তাঁরাই প্রণয়ন করেছে যারা পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ণের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।’ এই ‘অসাধারণ আবিষ্কারের’ জন্য এই চিন্তক বুদ্ধিজীবীকে একটি বড় ধরনের পুরষ্কার, একুশে পদক কিংবা স্বাধীনতা পদক দেয়া যায় কি না তা ভেবে দেখা দরকার। এই বুদ্ধিজীবীর জ্ঞানের পরিধি দেখে আমার মত অনেকে হতবাক ও বিস্মিত। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ কোন পটভূমিতে কিভাবে হয়েছিল সে বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের মাত্রা এবং পরিধি দেখে আমি হতবাক। অবশ্য এসব নিয়ে এখন তর্ক করা ভারী বিপদ। তর্ক করতে গেলে আপনার ওপর হুমকি আসবে, আপনাকে ঘেরাও করা হবে, আপনাকে ফ্যাসিবাদের দালাল হিসেবে অভিহিত করা হতে পারে। তাই আমরা শুধুমাত্র বাহাত্তরের সংবিধানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে চাই। সত্তরের সালের নির্বাচন পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েম করার জন্য অনুষ্ঠিত হয়নি। আওয়ামী লীগ ঐ নির্বাচনে জনগণের কাছে ম্যান্ডেট চেয়েছিল উদ্ধারের জন্য। সত্তরের নির্বাচন ছিল জনগণের কাছে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রশ্ন একটি ম্যান্ডেট। সেই ম্যান্ডেট জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছয় দফার পক্ষে বা স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে মতামত দিয়েছিলেন। আর এ কারণেই ভুট্টো এবং ইয়াহিয়া খান সংসদ অধিবেশন ডাকতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ছিলেন। বাংলাদেশকে এক অনিবার্য যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছিল। ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে জনসভার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণাই দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এবারে সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারে সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, তোমাদের যার যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দিবো, এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’

বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের পর স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে যারা প্রশ্ন করেন তারা অর্বাচীন অথবা জ্ঞান পাপী। সে প্রসঙ্গে এখন আর যেতে চাই না। কিন্তু ৭ মার্চের পর আসলে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির মৃত্যু ঘটে। এরপর ২৫ মার্চ নিমর্ম হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে পাকিস্তানিরা বাঙালী জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। বঙ্গবন্ধুর নিদের্শ অনুযায়ী গঠিত হয় মুজিব নগর সরকার এবং এই মুজিব নগর সরকার স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র তৈরি করে। সেটি স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি। নতুন সংবিধানের অঙ্কুর। অবশ্য চিন্তক বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন সময় বহুরুপ ধারণ করেছেন, ভোল পাল্টেছেন। কাজেই এসব ইতিহাস জানা থাকলেও তিনি বেমালুম ভুলে যাবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু থেকে ‘মুজিব নগর সরকার’ই বাংলাদেশের বৈধ সরকার। মুজিব নগর সরকার গঠিত হয়েছিল পাকিস্তানকে অস্বীকার করে জনপ্রতিনিধিদের সম্মিলিত অভিপ্রায়ে হিসেবে। জনপ্রতিনিধিরা হলেন জনগণের অভিপ্রায়ের প্রতিরূপ। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের এই সহজ সরল ব্যাখ্যাগুলো যদি কেউ বুঝে না বুঝতে চান তাহলে তাকে আপনি কিভাবে শেখাবেন? তারপর তিনি যদি হন একজন চিন্তক বুদ্ধিজীবী তাহলে তো কথাই নেই। তবে এই নব্য আবিষ্কৃত সংবিধান বিশেষজ্ঞের সাথে সুর মিলিয়ে এখন বহু সংবিধান বিশেষজ্ঞ সংবিধানকে বাতিল করা, সংবিধানকে পচাঁ বলা, সংবিধানকে অবমাননা করার এক বন্য উৎসবের কোরাস তুলেছেন। কথায় কথায় সংবিধানকে ছুঁড়ে ফেলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এমনকি রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দিলেও সংবিধানের কিছু হবে না-এমন সব ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। কেউ কেউ ফতোয়া দিচ্ছে সংবিধানটির কোনও দরকার নেই। বাহ্ কি চমৎকার।

সংবিধান থাকবে, কি থাকবে না, সংবিধান পুনর্লিখন হবে, না সংবিধান সংস্কার হবে সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। একটি দেশের সংবিধান পরিবর্তন হতেই পারে। একটি দেশে সংবিধান সুপরিবর্তনীয় ও দুস্পরিবর্তনীয় দুই রকম হয়। কোনও কোনও দেশের সংবিধান সহজেই পরিবর্তন করা যায়। এটি একটি আইনের মত, আবার কোনও কোনও দেশের সংবিধান দুস্পরিবর্তনীয়। যেখানে পরিবর্তন একটি জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায়। বাংলাদেশ বাহাত্তরে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে সংবিধান পেয়েছিল সেই সংবিধান বিভিন্ন সময় পদদলিত হয়েছে, লাঞ্ছিত হয়েছে, রক্তাক্ত হয়েছে। আর এ কারণেই সংবিধানের এই কাটাছেঁড়া, সংবিধান লঙ্ঘনের ধারা বন্ধ করার জন্য সংবিধানে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ধারা সংযোজন করা হয়েছে। সংবিধানকে দুস্পরিবর্তন করা হয়েছে এবং সংবিধানের কিছু কিছু ধারাকে অপরিবর্তনযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখলকেও রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে সংবিধানের ৭ এর ক-তে চিহ্নিত করা হয়েছে। সংবিধান সময়ের সাথে, মানুষের অভিপ্রায়ের সাথে বদলানো হয়, বদলে যায়। একটি সংবিধান কোনও ধর্ম গ্রন্থ নয়। এটি কখনোই পরিবর্তন করা যাবে না- এমনটি নয়। কিন্তু সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটি শিষ্টাচার এবং নিয়ম নীতি আছে। সংবিধান হলো জনগণের ইচ্ছার প্রতিরূপ। একটি রাষ্ট্রের জনগণের অধিকারের স্বীকৃতির সনদ হলো একটি সংবিধান। একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনার পদ্ধতি এবং জনগণের আইন, নিরাপত্তা হেফাজতের রক্ষাকবচ হলো একটি সংবিধান। কাজেই একটি সংবিধানকে ইচ্ছে করলেই যদি ছুঁড়ে ফেলে দেয়া যায় তাহলে জনগণের অধিকারকেই ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়। একটি সংবিধানের ধারা এবং আইন যদি ক্রমাগতভাবে অমান্য করতে থাকি তাহলে একটি রাষ্ট্র ‘মৎস্যন্যায় রাষ্ট্রে’ পরিণত হতে বাধ্য। আমরা যদি সংবিধানকে মেনে না চলি, তাহলে রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা, মৌলিক মানবাধিকার ইত্যাদি সব কিছু লঙ্ঘিত হবে৷ এক দানবের কাছে জিম্মি হয়ে যাবে। এই অবস্থা কারো কখনোই কাম্য নয়৷ কাজেই সংবিধানের মধ্যে থেকেই আমাদের সবকিছু করতে হবে।

বাংলাদেশে এখন এই সংবিধান থাকবে, কি থাকবে না তা নিয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ রূপী গুহা মানবদের বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই বিতর্কে কেউ কেউ সংবিধানকে বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়নের কথা বলেছেন। যিনি সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে পাশ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন তিনি এখন সংবিধান বিশেষজ্ঞ হয়ে জাতিকে নতুন সংবিধান উপহার দেয়ার মহান দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। বাংলাদেশে এখন এত বেশি মানুষ সংবিধান সম্পর্কে মতামত দিচ্ছেন তাতে একটি বিপন্ন প্রশ্ন আমাদের সামনে দেখা দিয়েছে। আর তা হলো আজ সংবিধান নিয়ে যা করা হচ্ছে আগামীকাল অন্য পক্ষ যদি তাই করে? সংবিধান যদি সহজেই কাটাছেঁড়া, ছুঁড়ে ফেলা বা পুড়িয়ে ফেলার জিনিস হয় তাহলে শেষ পর্যন্ত সংবিধান কি থাকবে? আর সংবিধান ছাড়া এই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কি বিপন্ন হবে না? আমরা কি রাষ্ট্রকে বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিচ্ছি? সংবিধানহীন, আইনহীন এক বন্য রাষ্ট্র হিসেবে কি আমরা বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই?

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত। ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com। ফেসবুক থেকে