জানুয়ারি ২১, ২০২৫
লেডিঞ্জে গ্রেন্ড, স্টকহোম,সুইডেন
বাংলাদেশ মতামত

ড. ইউনূস, আপনি কেন অং সান সুকি হতে চাইছেন, স্যার?

শামীম আহমেদ : আমার টরোন্টোর এক বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল। ৫ অগাস্ট ২০২৪ এর পর থেকে একটা বিশাল সম্প্রদায় আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের তীব্র অপরাধবোধে ভোগানোর চেষ্টা করছেন। এই চেষ্টার মধ্যে অর্ধেক সততা আর অর্ধেক শঠতা লুকিয়ে আছে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে অনেক দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা হয়েছে। সারাক্ষণ জি আপা, জি আপা হয়েছে, জি ভাই, জি ভাই হয়েছে। মনে রাখা দরকার এই একই কাজ বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলেই হয়ে থাকে। যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকারের পতন খুব বাজেভাবে হয়েছে, তাই তাদের দোষ-ত্রুটি বেশী চোখে পড়ছে, এটাই স্বাভাবিক। ২০০৬ সালে যখন বিএনপির পতন হলো, তখন সারা দেশের পুকুরে সেনাবাহিনী ঢেউটিন উদ্ধার করেছে, বিএনপির নেতাকর্মীদের জেলে পুরেছে। খাম্বার জন্য তারেক জিয়া সমালোচিত হয়েছে। ৩ কোটি টাকার দুর্নীতির জন্য খালেদা জিয়া হাউজ এরেস্ট ছিলেন একযুগেরও বেশী সময়। আর আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পিয়নই নাকি ৪০০ কোটি টাকা নিয়ে ভেগেছে, যেটি প্রধানমন্ত্রী নিজের মুখেই স্বীকার করেছেন। সুতরাং মানুষের রাগ-ক্ষোভ আছে, এটাই স্বাভাবিক এবং যতক্ষণ তা সভ্য – ততক্ষণ তা গ্রহণযোগ্যও বটে। কিন্তু এতেও সন্দেহ নেই যে আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী নেতাকর্মী, পদপ্রাপ্ত ব্যক্তিবিশেষ (এই সংখ্যাটাও নেহায়েত কম নয়) ছাড়া অন্য সচেতন সমর্থকদের অনেকেই যেভাবে দেশে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছিল (বা হচ্ছিল না) তাতে উদ্বিগ্ন ছিল। আমার সেই বন্ধুটি ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর ঘোষণা দিয়ে জানায় যে সে আর বর্তমান নেতৃত্বের আওয়ামী লীগে আস্থাশীল নয়। এই আওয়ামী লীগকে সে আর ভোট দেবে না। যে বন্ধুটির কথা বলছি সে যে-সে কেউ নয়; আমাদের ব্যাচে ২ লক্ষ ছেলেমেয়ের মধ্যে মেধা ও মননশীলতায় সে শীর্ষ ৫০ এ থাকবে যে কোন অর্জন বিচারেই। সেই বন্ধু আমাকে একদিন চা পান করতে করতে বলছিল, আওয়ামী লীগের শিক্ষিত সমর্থকদের মধ্যে অন্য দলের সমর্থকদের চাইতে নিজেদের সমালোচনা করার সামর্থ্য অনেক বেশী। এই যে আওয়ামী লীগ কেন নিজেদের সমালোচনা করে না – এই যে মেটিকুলাসলি ডিজাইন্ড ব্লেইম গেইম, এটা মূলত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির একটা পরিকল্পিত ক্যাম্পেইন। চিন্তা করেন, একটা গোষ্ঠী যারা ১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ মানুষকে খুন, ২ লক্ষ নারীকে ধর্ষণ করার জন্য এখনও ক্ষমা চায় নাই, তারা আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমা প্রত্যাশা করে, তাদের দল নিষিদ্ধ করার প্রস্তুতি নেয়।

এতে কোন সন্দেহ নেই দেশের অনেক মানুষ বছরের পর বছর ভোট দিতে না পেরে বীতশ্রদ্ধ ছিল। তারা সীমাহীন দুর্নীতি, আওয়ামী নেতাদের দুঃশাসন দেখে বিরক্ত, ক্ষুব্ধ ছিল। কিন্তু এটিও সত্য যে অর্থনীতির “Trickle Down Effect” এ, অর্থাৎ কলসি যখন পানিতে ভরে যায়, তখন সেই পানি আবার গড়িয়ে নিচে পড়ে – এই তত্ত্বে ভর করে গরীব-দুঃখী মানুষরাও কিছু সুবিধা পাচ্ছিল। রিকশাওয়ালা-ভ্যানওয়ালা-মুদি দোকানদার-নাপিত-মুচি-ধোপা-ফুড ভেন্ডর-দোকানদারসহ সমাজের নিচের স্তরের মানুষের আয় রোজগার ভাল ছিল, তারা দুটো ভাল-মন্দ খেয়ে জীবনটাকে এগিয়ে নিচ্ছিল। মধ্যবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্তরা ভাল পড়াশোনা করে, ইদের সময় “ছিঃ রক্ত দেখতে চাই না” বলে থাইল্যান্ড, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া ঘুরে বেড়াতে পারছিল। উচ্চবিত্তদের কথা তো আর বলার কিছু নাই, তারা ব্যাংক-বীমা খালি করে দিচ্ছিল, দেশের বাইরে সবাই দ্বিতীয় দেশ গুছিয়ে নিচ্ছিল। যারা প্রবাসী ছিল, তারা নিঃসন্দেহে গত ১৬ বছরে নিজেকে বাংলাদেশী হিসেবে বুক ফুলিয়ে পরিচয় দিতে পেরেছে। আমি ৮ বছর ক্যানাডায় আছি, কেউ আমাকে কখনও বলে নাই, তোমাদের শেখ হাসিনা তো নির্বাচন দেয় না, আমাকে সবাই বলেছে তোমাদের দেশ এখন ইন্ডিয়ার পরে সাউথ এশিয়ায় সবচেয়ে এগিয়ে, তোমাদের নারী স্বাধীনতা কেবলমাত্র মুসলিম দেশ হিসেবেই নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও ঈর্ষনীয়, তারা দেশের সব শীর্ষ পর্যায়ে মেধা নিয়ে জায়গা করে নিতে পারছে, তোমাদের জিডিপি স্থিতিশীল, তোমাদের রিজার্ভ পৃথিবীর শীর্ষ ৩৫ টি দেশের একটি, তোমাদের অর্থনীতি মজবুত, তোমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে, তোমরা পদ্দা সেতু নিজেদের অর্থায়নে করেছ, তোমরা জাতিসংঘ, আমেরিকার অন্যায় দাবী ধমক দিয়ে থামিয়ে দিতে পারো। এই কথাগুলো আমরা শুনেছি, বাংলাদেশী হিসেবে গর্বিত হয়েছি।

বাংলাদেশে বছরের পর বছর নির্বাচন হয় না, সীমাহীন দুর্নীতি করে কিছু মানুষ দেশের বেশীরভাগ সম্পদ লুটে নিয়ে যাচ্ছে, এটি আমাদের ভাবিয়েছে, উদ্বিগ্ন করেছে, বিরক্ত করেছে, কিন্তু বেশীরভাগ মানুষ নিজের জীবনমান নিয়ে সুখী ছিল। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দূর্নীতির প্রাচুর্য না থাকলে দেশের মানুষের অবস্থা আরও ভাল হতো, এই কথাটি অত্যন্ত সরলীকরণ হয়ে যায়, কেননা দেশ ভাল থাকার জন্য কেবল দুর্নীতি ঠেকালেই হয় না, অর্থের সুষম বন্টন জরুরী, ব্যবস্থাপনা জরুরী, নিয়ন্ত্রণ জরুরী। যদি ধরে নিই, শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ সরকার ছিল, তাহলে আগের সরকারগুলোর সময়ে দুর্নীতি এত কম থাকা সত্ত্বেও দেশে অবস্থা এত খারাপ ছিল কেন? প্রতিদিন ৬ ঘন্টা লোডশেডিং এ থাকতে হতো, ঘন্টার পর ঘন্টা ফেরীতে করে নদী পার হতে হতো, দেশের বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর উপযুক্ত ভাতা ছিল না। প্রতিবন্ধী-বিধবা-মুক্তিযোদ্ধারা ধুঁকে ধুঁকে মরেছেন কেন তাদের সময়ে?

গত ৩ মাসে দেশের অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছে যা আমাদের হতাশ করেছে। চরম আওয়ামী লীগের সমর্থক ব্যক্তিটিও ভেবেছিল ডঃ ইউনুস অন্তর্বর্তী দায়িত্ব নিয়ে নিশ্চয় শেখ হাসিনার মতো হিংসার রাজনীতি, প্রতিশোধের রাজনীতি করবেন না। কিন্তু তিনি যে কোন বিবেচনায় শেখ হাসিনাকে বহুগুণে ছাড়িয়ে গেছেন, তিনি হত্যা-খুনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, প্রজ্ঞাপন-পরিপত্র জারি করে বলেছেন, ৫ অগাস্ট পরবর্তী অনেক হত্যাকান্ডের জন্য মামলা নেয়া যাবে না, অর্থাৎ বিচার হবে না। এমনকি ১৫ জুলাই থেকে ৫ অগাস্ট আন্দোলনে আহত ছাত্রদের চিকিৎসা করাতেও তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। অথচ সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলনে ষড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দেয়া রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনায় অযোগ্য ব্যক্তিদের ক্ষমতা দিয়েছেন, পতাকা দিয়েছেন, সুইজারল্যান্ড ঘুরিয়ে এনেছেন, সারা দেশে তাদের যা ইচ্ছা তা করার ম্যান্ডেট দিয়েছেন। কোন সাংবিধানিক অধিকার না থাকা সত্বেও ডঃ ইউনুস ও তার উপদেষ্টারা বাংলাদেশের সংবিধানে হাত দিয়েছে, তাকে বিকৃত করার প্রচেষ্টা নিয়েছে, যা অবশ্যই অবশ্যই বাংলাদেশে বেশীদিন টিকবে না।

বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, কিন্তু আমরা যখন বিদেশের মাটিতে আমাদের বিদেশী বন্ধু-সহকর্মী-ছাত্রদের বাংলাদেশ চেনাই, তাদের বলি বাংলাদেশ মুসলমান প্রধান দেশ হলেও এটি পাকিস্তান নয়, আফগানিস্তান নয়, এটি ভিন্ন। আমাদের মুসলমানরা সহনশীল। আমাদের নারীরা চাকরি করে এসে শাড়ি পরে পহেলা বৈশাখের উৎসবে যায়, আমাদের পুরুষেরা জুম্মা পড়ে এসে জেমসের কনসার্ট দেখতে যায়, আমাদের শিশুরা হাত ধরাধরি করে ফুচকা-চটপটি-নাড়ু-পায়েস খায়। ধর্ম ও সংস্কৃতির এমন মিথষ্ক্রিয়া পৃথিবীর আর কোন মুসলিম প্রধান দেশে নেই। আমাদের পুরো ধার্মিক বাবাটিও জীবনের এক পর্যায়ে চান তার মেয়েটি হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতে শিখুক, ছেলেটি তবলা বাজিয়ে তাতে দ্যোতনা দিক। আমাদের ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়া মা-ও সন্তানের হাত ধরে গ্রামের মেলায় ঘুরে আসেন, ঘুড়ি-নাটাই-খেলনা বাদ্যযন্ত্র কিনে দেন। আমাদের দেশের চরম ধার্মিক মানুষটির ভেতরেও একজন সুপ্ত সংস্কৃতি কর্মী লুকিয়ে আছেন, চরম সংস্কৃতিকর্মীর মধ্যেও একজন ধার্মিক মানুষ লুকিয়ে আছেন। মাগরেবের আজানের সময় জীবনেও নামাজ পড়েন না, এমন মানুষটিও টিভি-রেডিওর সাউন্ডটা আনমনে কমিয়ে আনেন।

এই যে সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বাংলাদেশ, ডঃ ইউনুস ও তার উপদেষ্টা এবং তাদের মাস্টারমাইন্ডরা মাত্র ৩ মাসে সেটিকে গলা চিপে হত্যা করেছেন। বাংলাদেশকে নিয়ে এখন পাকিস্তানের ভ্লগাররা রিলে, ইউটিউবে হাসাহাসি করে! দেশে ফোন করে দেশের অবস্থা কী আর জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে না, সারা দেশে প্রতিদিন অরাজকতা নতুন মাত্রা নিয়েছে, যা আমরা মাত্র ৩ মাস আগেও ভাবতে পারিনি।

১৬ বছরের আবর্জনা পরিষ্কার করতে ১০ বছর লাগবে – এই ন্যারেটিভ বেচা-বিক্রির দিন শেষ। ডঃ মুহম্মদ যে কোন দিন সন্ধ্যায় টিভিতে এসে একটা ৫ মিনিটের ভাষণ দিয়ে দেশের এই অরাজকতা থামিয়ে দেবার চেষ্টা করতে পারতেন। তিনি যদি কঠোর ভাষায় বলতেন, আমার সরকার এইসব হত্যা-খুন-ধ্বংস-ভাংচুর মেনে নেবে না এবং জড়িতদের কঠোর বিচার করা হবে – তাহলে আজকে দেশের যে ভয়াবহ অবস্থা তা এতদূর গড়াতো না। কিন্তু আমার এখন আসলেই মনে হচ্ছে সবকিছু ডঃ ইউনুসের হাতে নেই অথবা তিনি দেশের উন্নয়নে মোটেও আগ্রহী নন। আমরা আগেও বলতাম গ্রামীন ব্যাংকের ডঃ ইউনুস আর ব্র্যাকের ফজলে হাসান আবেদের পার্থক্য হচ্ছে, আবেদ একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছেন আর ইউনুস নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন। ডঃ ইউনুস দেশে চলমান অরাজকতা, যেটি অনেকটা ক্রমশ গৃহযুদ্ধের রূপ নিচ্ছে, সেটি তো ঠেকানোর চেষ্টা করছেনই না, বরঞ্চ ধ্বংসযজ্ঞের জাদুঘর বানানো, দেশের সব স্থাপনার নাম পরিবর্তন, নিজের প্রতিষ্ঠানের দায়দেনা মুক্তি দেয়া, জাতির জনকের ছবি ও নাম অপসারণে যেভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাতে করে মনে হচ্ছে, তার কাছে নতুন কিছু আশা করা বাতুলতা মাত্র।

ডঃ ইউনুস যেভাবে সরকার চালাচ্ছেন, তাতে করে খুব স্বাভাবিকভাবেই মানুষ শেখ হাসিনার সাথে তার তুলনা করতে শুরু করেছেন। আগেই ভাল ছিলাম এই ন্যারেটিভও দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। যত দিন গড়াবে এই ন্যারেটিভ তত শক্তিশালী হবে, এবং ডঃ ইউনুস যদি এভাবেই দেশ চালাতে থাকেন, কয়েক মাস পরে শেখ হাসিনার শাসনামল বেশীরভাগ মানুষের কাছে বেহেশত মনে হওয়া শুরু করলেও আমি বিস্মিত হব না। শেখ হাসিনা নির্বাচন দেন না, অগণতান্ত্রিক সরকার – এই অভিযোগে ডঃ ইউনুস ক্ষমতায় এসেছেন, মনে রাখতে হবে দ্রুত নির্বাচন না দিলে ডঃ ইউনুসের সরকারও একই পথে হাঁটছে।

এটি দুর্ভাগ্যজনক যে প্রথমবারের মতো দেশের প্রায় সব নাগরিক, প্রায় সব দলের সমর্থকরা খুশী বা বেজার মনে হলেও আশা করেছিল ডঃ ইউনুস প্রতিহিংসা-খুন-জখমের রাজনীতি থেকে সরে এসে বাংলাদেশকে হয়ত একটি নতুন চেহারা দেবার চেষ্টা করবেন। তা হয়নি। আমরা শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আশাবাদী থাকতে চাই, কিন্তু আফসোস, আশাবাদী হবার মতো খুব বেশী উপাদান এখন আর আমাদের হাতে নেই। #৩৬জুলাই। ২৭ নভেম্বর ২০২৪। লেখক ও গবেষক। ফেসবুক থেকে