শামীম আহমেদ : আলুর দাম সামনে ১০০০ হাজার টাকাও হবে, কিন্তু আওয়ামী লীগ সহসা ক্ষমতায় আসবে না। কেন আসবে না জানেন? কারণ গঠনমূলক চিন্তা নাই কারও। আওয়ামী লীগের পরিচিত যেসব মুখ, প্লাটফর্ম, বুদ্ধিজীবী ঘরানার মানুষজন আছে, নানাভাবে তাদের নানাজন গত ৩ মাসে যোগাযোগ করছে, কথা বলছে, একসাথে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করছে। জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কী চান বলেন?
একেক জনের একেক চাওয়া, কিন্তু মোটামুটি সবাই শেখ হাসিনাকে আবার প্রধানমন্ত্রী চায়। আমি বললাম ভাই, ছাত্র আন্দোলনে গোলাগুলি, ছাত্র হত্যা আর ষড়যন্ত্র রোখার ব্যর্থতার কথা যদি বাদও দেন, উনার বয়সটা চিন্তা করেন। আর কত? তারপর বলেন, উনি এত বছর ক্ষমতায় ছিল, দ্বিতীয় কাউকে উঠতে দিছেন? দেন নাই তো! তার আশেপাশে সবাই অকর্মন্য। একমাত্র যোগ্যতা আছে সম্ভবত পুতুলের। কিন্তু কেউ তারে নিয়ে আলাপ করে না। সবাই আবার ফিরাইতে চায় শেখ হাসিনা আর জয়কে। বয়সের জন্য হইলেও মায়া-দয়া করা দরকার।
অথচ কেউ গঠনমূলক কিছু করার কথা বলল না। কেউ বলল না – আসেন একসাথে লিখি, কথা বলি কেন সংবিধান সংস্কার একজন আমেরিকান সাংবাদিকের করা উচিৎ না। আলোচনা করি কেন সংবিধান ১৯৭২ এর টাই সেরা। কেউ বলল না আগামী ২০ বছর দলের গঠনতন্ত্রে কী কী পরিবর্তন আনা দরকার সেটার ড্রাফট বানাই। চলেন, ১৫ জুলাই থেকে ৫ অগাস্ট যে কোটি কোটি শিক্ষার্থীর সমর্থন হারাইছি, তাদের দলের গুরুত্ব বোঝানোর কমিউনিকেসন স্ট্র্যাটেজি তৈরী করি। কেউ বলল না, এই যে উগ্র ধর্মীয় শক্তির উত্থান, নারীর অধিকার খর্ব, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, সেটা থামানোর জন্য একটা ‘পজিসন পেপার’ তৈরী করি।
কেউ বলল না এই যে হাজার হাজার পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সমর্থক পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো, অন্তর্বর্তী সরকার সেটাকে ‘দায়মুক্তি’ দিল, সেটা নিয়ে এটা আন্তর্জাতিক আইন ও সংবিধানের কোন কোন ধারাকে বিঘ্নিত করল, সেটা নিয়ে একটা গবেষণাপত্র তৈরী করি।
কেউ বলল না ১৫ জুলাই থেকে ৫ অগাস্ট যেসব ছাত্র-জনতা নিহত হলো, তাদের সম্মানে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোন একটা উদ্যোগ নিই।
কেউ বলল না এই যে কেবলমাত্র মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি হওয়ায় দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে দেয়া হচ্ছে না, চলেন সেটার প্রতিবাদ করি! ২০ কোটি মানুষের দেশে যথেষ্ট ডাক্তার নাই, অথচ শত শত ডাক্তারকে তাদের ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা দিতে না দিয়ে বহিষ্কার করা হয়েছে কেবলমাত্র আওয়ামী লীগ করার অপরাধে – চলেন, এই বিষয়ে ইংরেজিতে ডকুমেন্টারি বানাই।
কেউ কেউ বলেছেন, ভাই আসেন নিজেদের বিবেকের জন্য কাজ করি। আমি বললাম ভাই আমার বিবেক সার্ফ এক্সেলের মতো ফকফকা। ১৫ জুলাই থেকে ৫ অগাস্টের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ করেছি, আবার ৫ অগাস্টের পর যখন আওয়ামী লীগের বেশীরভাগ সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবীরা প্রোফাইল বন্ধ রেখেছিল, তখন ৭ অগাস্ট ২০২৪, দেশব্যাপী চলমান গণহত্যারও প্রতিবাদ করেছি, এখনও সমানতালে করছি। বিবেকের জন্য গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার পক্ষে কাজ করার দরকার আমার নাই। যারা গত ১৫ বছর পদ নিছেন, টাকা নিছেন, সুবিধা নিছেন – তারা এটা করেন।
সবাই খালি অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে কাজ করতে চান। শেখ হাসিনা আর জয়কে ফিরিয়ে এনে ক্ষমতা বুঝিয়ে দিতে বলেন। আলুর দাম ৪০০ টাকা সেটা মনে করিয়ে দিয়ে আগে কত ভাল ছিল সেটা নিয়ে লেখালেখি করতে বলেন। আরে ভাই, অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে লেখার অনেক লোক আছে, তারা লিখবে। তাছাড়া এই সরকার ইতিমধ্যে মৃত। এরপর বিএনপি আসবে, জামায়েত আসবে, কিন্তু নিজেদের নিয়ে কাজ না করলে আওয়ামী লীগের ভাগ্য পরিবর্তন হবে না! এই বিষয়ে কথা বলতে কেউ আসল না। আপনারা কি ভুলে গেলেন আওয়ামী লীগ না বললে দেশের গরীব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা অন্য কেউ বলে না?
যাদের হাতে আপনার দেশ, সেই উপদেষ্টারা একজনও বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করে? সবাই একেকজন গুলশান-বনানী-ধানমন্ডির ঘি-বাটারে ভাজা সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে। ধাম করে একদিন টরোন্টো-সিডনি-নিউইয়র্ক-ব্রিকলেনের চাচী’স চায়ে বসে সেলফি দিবে, টেরও পাবেন না। ওদিকে আপনি থাকবেন অন্ধকারে, মশার কামড় খাবেন আর ভাববেন আহারে আলুর কেজি ১০০০ টাকা; জিনিসটা ভাল ছিল – সব তরকারিতে দেয়া যাইতো!
আমার দুঃখ চোখের সামনে দেশের সকল প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী-শিল্পী-সাহিত্যিক-সমাজকর্মীকে গত ১৬ বছরে দূরে সরিয়ে ছা-পোষা কিছু তোষামোদকারীদের দিয়ে দলকে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে! এরা প্রেস কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রীকে বলত “আপনি আমাদের মায়ের মতো!” আরে ভাই দুনিয়ার কোন দেশে দেখি নাই টিভি চ্যানেলের প্রধান সাংবাদিকরা প্রধানমন্ত্রীকে মা বলে, স্যালুট দেয়! কেউ বলল না আসেন আমরা আগামী ৫ বছরে এইসব হারিয়ে যাওয়া প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী-শিল্পী-সাহিত্যিক-সমাজকর্মীকে মুক্তিযুদ্ধের পতাকাতলে জড়ো করি!
ভাই আলু তো আলু! দেশটা ধ্বংস হয়ে যাবে চোখের সামনে; খালি দশ বছরে দেখেন। জাতীয় সঙ্গীত, সংবিধান, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা, ধানমন্ডি ৩২, জাতির স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান, অসম্প্রদায়িকতা – দেশের মূল গর্ব, অহংকার, ভিত্তি সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ধর্মীয় মৌলবাদীরা ক্ষমতার শীর্ষ থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে লাল-সালু গেড়ে বসছে। আর আপনারা আছেন শেখ হাসিনা-জয় আর আলুর দাম নিয়ে? নভেম্বর ১৯, ২০২৪। লেখক ও গবেষক। ফেসবুক থেকে