সমুদ্র দূষণ রোধে আশার আলো দেখাচ্ছে জাপানের নতুন আবিষ্কার
বর্তমানে গোটা বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক দূষণ বিশ্বের অন্যতম গুরুতর পরিবেশগত সংকট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। বিশেষ করে, সমুদ্রের বিশাল জলরাশিতে প্লাস্টিকের উপস্থিতি আজ পৃথিবীর সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য ভয়াবহ রকমের হুমকি সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির মতে, প্রতি বছর আনুমানিক ৮০ লাখ টনের অধিক প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে জমা হচ্ছে, যা সামুদ্রিক ইকোসিস্টেম এবং জলজ প্রাণী টিকে থাকা নিয়ে প্রবল আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা।
বর্তমানে পেট্রোলিয়াম-ভিত্তিক প্লাস্টিক বিগত ৭০ বছরেরও বেশি সময় যাবত মানুষের দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।প্লাস্টিক আমাদের জীবনে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা প্রদান করলেও এটি কিন্তু এখন এটি পৃথিবীর জন্য এক মারাত্মক ক্ষতির কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। পৃথিবীর মহাসাগরগুলিতে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ বর্তমানে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন টন বলে অনুমান করা হয়েছে, যা কিনা প্রতি বছর গড়ে প্রায় আট মিলিয়ন টন হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তবে আশা কথা হল যে, সাম্প্রতিক সময়ে জাপানের একদল বিজ্ঞানী এমন এক ধরনের প্লাস্টিক তৈরি করেছেন, যা কিনা সামুদ্রিক পানির সংস্পর্শে এলেই অল্প সময়ের মধ্যে গলে গিয়ে পরিবেশে সাথে সম্পূর্ণরূপে মিশে যায়। এই প্লাস্টিক থেকে নতুন কোন ক্ষতিকর বর্জ্য তৈরি হওয়ার সম্ভবনা নেই। এই নতুন প্লাস্টিক ভবিষ্যতে সমুদ্রের ভয়াবহ প্লাস্টিক দূষণ কমাতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তাই অনেকেই মনে করছে সমুদ্র দূষণ রোধে আশার আলো দেখাচ্ছে জাপানের নতুন আবিষ্কার। যদিও বিজ্ঞানীদের এই পরীক্ষাটি এখনো পর্যন্ত গবেষণার একেবারে প্রাথমিক স্তরে রয়েছে।
জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (Osaka University) গ্র্যাজুয়েট স্কুল অফ সায়েন্সের অধ্যাপক ইয়োশিনোরি তাকাশিমা এবং গ্র্যাজুয়েট স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক হিরোশি উয়ামা এবং কিয়োইশা কেমিক্যাল (সভাপতি ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কিয়ো কাতাওকা) সহ একটি গবেষণা দল গত ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসের দিকে দাবি করে যে, তারা একটি নতুন আণবিক নকশা তৈরি করে একটি জৈব-অবচনযোগ্য পলিমার (প্লাস্টিক) তৈরি করেছেন।
তাদের এই গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল এমন একটি পরিবেশ বান্ধব পলিমার তৈরি করা, যা পানিতে পড়ে বছরের পর বছর টিকে না থেকে সমুদ্রের বুকে খুব দ্রুত ও নিরাপদভাবে নিজে নিজেই ভেঙে যাবে এবং কোন রকম পরিবেশ দূষণ না ঘটিয়ে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির সাথে মিশে যাবে। যাকে বর্তমানে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সামুদ্রিক পরিবেশ সুরক্ষায় এক যুগান্তকারী উদ্ভাবন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে এবং এর উন্নয়ন ও গবেষণা এখনো পর্যন্ত চলমান রয়েছে।
জাপানের বিজ্ঞানীরা ল্যাবে নতুন এই পরিবেশ বন্ধন প্লাস্টিক পলিহাইড্রক্সি বাটিরেট (PHB) নামক একটি প্রাকৃতিক জৈব বিশ্লেষণযোগ্য উপাদান দিয়ে তৈরি করছেন। পলিহাইড্রক্সি বাটিরেট (PHB) মূলত ব্যাকটেরিয়া দ্বারা উৎপাদিত একটি পলিমার, যা মাটিতে বা পানিতে সহজেই ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ভেঙে যায়। বিজ্ঞানীরা PHB-এর গঠন ও গলন গতি আরও উন্নত করে একে নতুন পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক রূপে রূপান্তর করার কাজে বড় ধরনের সফলতা দাবি করেছেন।
জাপানি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত উন্নত পলিহাইড্রক্সি বাটিরেট (PHB) হচ্ছে একটি প্রাকৃতিক জৈব-বিয়োজ্য পলিমার। যা পরিবেশ বান্ধন প্লাস্টিক হিসাবে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। এটি তৈরিতে ব্যাকটেরিয়া (যেমন Cupriavidus necator) চিনি বা জৈব বর্জ্য থেকে কার্বন উৎস ব্যবহার করে PHB সংশ্লেষ করে, যা কোষের ভেতর শক্তি সঞ্চয় হিসেবে জমা হয়। পরে এটি নিষ্কাশন করে প্লাস্টিক তৈরি করা হয়। এটি মাটি, সমুদ্র বা জলজ পরিবেশে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া PHB-কে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও জলে ভেঙে ফেলে অল্প সময়ের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে যায়।
গবেষণাগারে একাধিক পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, পলিহাইড্রক্সি বাটিরেট (PHB) পলিমার উপাদানের তৈরি প্লাস্টিক সমুদ্রের পানিতে পড়ে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে গলতে শুরু করে এবং খুব দ্রুত ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে জৈব বিশ্লেষিত হয়। এটি কোনো বিষাক্ত পদার্থ বা ক্ষতিকর বর্জ্য কিংবা অবশিষ্টাংশ তৈরি করে না, যা সাধারণ প্লাস্টিকের ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা যায়। তবে এই গবেষণার সফলতা দাবি করা হলেও তা বাস্তবে পরিবেশ সুরক্ষায় ব্যবহারের উপযোগী হয়ে বাজারে আসাটা এখনো পর্যন্ত একটি চ্যালেঞ্জিং ইস্যু হয়ে থেকে গেছে।
বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন যে, পরিবেশ বান্ধব এই জৈব প্লাস্টিক বিভিন্ন উপায়ে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। বিশেষ করে একবার ব্যবহারযোগ্য খাবারের প্যাকেট বা চামচে, মাছ ধরার জাল ও দড়িতে, শিল্পখাতে উৎপাদিত প্যাকেজিং সামগ্রীতে এবং মেডিকেল উপকরণেও এটি ব্যবহার করা সম্ভব। তাছাড়া বিশেষ করে সমুদ্র ঘেঁষা অঞ্চল বা মেরিন ইন্ডাস্ট্রিতে এর কার্যকর ব্যবহার অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। যদিও বিজ্ঞানীদের নতুন আবিষ্কৃত এই প্লাস্টিক বাস্তবে খুবই সহজলভ্য হবে বিষয়টি তা কিন্তু মোটেও নয়।
গবেষণাগারে সফলতার পাশাপাশি এই নতুন প্লাস্টিক যদি ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে বা বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়, তবে এটি সমুদ্র দূষণ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস করতে পারে এবং একটি সুন্দর পরিবেশ এবং টেকসই পৃথিবী গঠনে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আশা করে বিজ্ঞানীরা। তবে এখনও পর্যন্ত এই জৈব প্লাস্টিকের উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে অনেকটাই বেশি বলেই প্রতীয়মান হয়। এই প্রজেক্ট সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা এখন এর উৎপাদন আরও সহজ, সাশ্রয়ী এবং ব্যাপকভাবে তৈরি করার কার্যকর উপায় বের করার জন্য নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের সফলতাই আমাদেরকে সমুদ্র দূষণ রোধে আশার আলো দেখাবে ।
তথ্যসূত্র:- সায়েন্স জাপান, দ্য ইউনিভার্সিটি অব ওসাকা।
যোগাযোগ: লেখক সিরাজুর রহমান voiceofsweden.online