জানুয়ারি ২৩, ২০২৫
লেডিঞ্জে গ্রেন্ড, স্টকহোম,সুইডেন
মতামত রাজনীতি

নূর হোসেন দিবসের কর্মসূচি থেকে দৃশ্যমান লাভ আওয়ামী লীগ খুঁজেছে বলে মনে হচ্ছে না

কবির য়াহমদ : শহিদ নূর হোসেন দিবসে রাজধানীর জিরো পয়েন্টে নেতৃত্ব সংকটে থাকা আওয়ামী লীগ উল্লেখের মতো জনসমাগম করতে পারেনি। বিক্ষিপ্ত কিছু নেতাকর্মী এদিকওদিক ছড়িয়ে ছিলেন ঠিক, কিন্তু সাহস সঞ্চয় করে সামনে এগুতে পারেননি। আক্রমণাত্মক হয়ে থাকা প্রতিপক্ষের সামনে তাদের দাঁড়াতে পারার কথা না, তারা সে চেষ্টা করেনি। ফলে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা হয়নি।

একই স্থানে কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের দুই পক্ষকে নিবৃত্ত করার রীতি ও নিয়ম। এসব ক্ষেত্রে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এবার এই রীতির ব্যত্যয় হয়েছে। পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনী কেবল একটা পক্ষকে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগকে প্রতিহত করতে প্রস্তুত ছিল। তারা সফল হয়েছে।

আওয়ামী লীগ মুখোমুখি রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের জন্যে এখনই প্রস্তুত কোন দল নয়। নেতৃত্ব সংকটে থাকা দলটি সাংগঠনিকভাবে যেমন অগোছালো, তেমনি দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রেও দিশাহীন।
ভঙুর সাংগঠনিক অবস্থায় নূর হোসেন দিবসে বাইরে বেরুনোর এই কর্মসূচিকে অনেকেই অপরিণামদর্শী ভাবতে পারেন। তবে সুদূরপ্রসারী চিন্তা করলে এটাকে অপরিণামদর্শী ভাবার কারণ নাই।

বিপ্লব-প্রতিবিপ্লব নামে যে কথাগুলো প্রায়শই আওড়ানো হচ্ছে, এসব হবে না। প্রতিবিপ্লবের জন্যে প্রস্তুত নয় আওয়ামী লীগ, এমনকি হাজার খানেক লোক সমাগমের সক্ষমতা নাই এখন। এই হাজার খানেক লোক সমাগমের সক্ষমতা না থাকা মানে তাদের জনসমর্থন শূন্যের কোটায় এমন ভাবনা অযৌক্তিক। ঢাকায় ক্ষমতায় হারিয়েছে দলটি, কিন্তু মানুষের মধ্যকার সমর্থন থেকে গেছে আগের মতোই।

বংশ পরম্পরায় আওয়ামী লীগ করে এমন লোকের সংখ্যা দেশে বেশি। এই অবস্থার ধারে-কাছে আছে কেবল বিএনপি। অন্য কোন দলের এমন গণভিত্তি নেই। বর্তমান ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতাঘনিষ্ঠ লোকদের ভয়ের জায়গা এখানে। তাই তারা আওয়ামী লীগকে মাঠে নামতে দিচ্ছে না, দেবেও না। তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে চায়, কিন্তু এটা সম্ভব না বলে মূলত দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কারণে।

আওয়ামী লীগ যত যাই করুক, নির্বাচনের দাবি করতে যাবে না। নির্বাচন যত দেরিতে হবে আওয়ামী লীগের তত লাভ। ক্ষতির পাল্লা ঝুঁকবে বিএনপির দিকেই।
প্রবল শক্তিশালী সামাজিক কাঠামোর দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে দলীয় বিভাজনের ক্ষেত্রটা ক্রমে সঙ্কুচিত হতে যাচ্ছে। আগের মতোই সমাজে আওয়ামী লীগ-বিএনপির লোকেরা বসবাসের অনুশীলনে ফিরতে শুরু করেছে। বাইরে বা শহরে যাই হোক গ্রামে-গ্রামে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াতের সংঘাত-সংঘর্ষ নেই। বরং আগের মতো মিলেমিশে বসবাসের পরিবেশ রয়েছে। আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মাঝে গ্রেপ্তারের ভয় আছে সত্য, কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতি করা প্রতিবেশীরা তাদের বড় ধরনের ক্ষতি করে ফেলবে, এমন আশঙ্কা এখন নেই অনেকটাই। দিন যত বাড়বে সৌহার্দ্যের পরিবেশ তত বেশি সম্প্রসারিত হবে।

গ্রামপ্রধান দেশের দেশ পরিস্থিতি যখন এমন, তখন কেন আওয়ামী লীগ হুট করে ছোট একটা কর্মসূচি দিলো? সহজ উত্তর হচ্ছে, নেতাকর্মীদের হারানো বিশ্বাসকে ফিরিয়ে আনা, এবং কিছু তথ্যপ্রমাণ জোগাড়ের চেষ্টা করা। প্রতিপক্ষের কেমন শক্তি, এটা দেখা জরুরি ছিল না আওয়ামী লীগের, কারণ আওয়ামী লীগ রাস্তায় নামলে সবাই একজোট হয়ে মাঠে নামবে; এবং এটাই স্বাভাবিক। এখানে আওয়ামী লীগের দরকার ছিল সরকারের প্রতিহিংসার রাজনীতিকে সামনে আনা, এবং এটা দেশের মানুষদের দেখাতে নয়, বিদেশিদের দেখানো। আওয়ামী লীগ বিদেশিদের দেখাতে চায়, কোন কারণ ছাড়াই সরকার এবং সরকারঘনিষ্ঠরা কীভাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মী ও দলের নারী কর্মীদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে, কীভাবে দেশের সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম চুপ থেকে এটাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। ছোট একটা কর্মসূচি দিয়ে বৃহৎ অনেক কিছু এখানে পেয়ে গেছে তারা।

দেশে আওয়ামী লীগের মাঠের রাজনীতি নাই। এর অর্থ এই নয় যে, সব জায়গায় দলটির রাজনীতি থেমে গেছে। বিদেশে আওয়ামী লীগ বন্ধুহীন হয়ে পড়েছিল তৎকালে সরকারের একগুঁয়েমির কারণে। তারা সেই ভুল স্বীকার না করলেও, ওখান থেকে শিক্ষা নেওয়ার পথে এগুচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে (আইসিসি) ৮০০ পৃষ্ঠার নথি উপস্থাপন ও অভিযোগ দায়ের সে ক্ষেত্রে একটা বড় উদাহরণ। জাতিসংঘের তদন্তকারী একাধিক দল এরইমধ্যে দেশে এসে দীর্ঘদিন কাজ করেছে। ওখানে আওয়ামী লীগ সশরীর উপস্থিত না থেকেও বেশ কিছু তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করেছে, আরও করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সরকার-পক্ষ থেকে যা কিছু উপস্থাপিত, সেটা দাপ্তরিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে থেকে গেছে। সরকারপক্ষ এখন বিজয়ীর আসনে, তাই কে কী বলছে, কে কী ভাবছে; সে সব পরোয়া না করার পথে রয়েছে। এখানে উপস্থাপনগত সীমাবদ্ধতার বিষয়টি বেশি বলেই মনে হচ্ছে।
আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বকে এতদিন পাত্তা না দেওয়া আওয়ামী লীগ এখন তাদের দিকেই চেয়ে আছে। যে আমেরিকা কিছুদিন আগেও আওয়ামী লীগের ‘শত্রু’ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছিল, সে আমেরিকার দিকেই এখন তাকিয়ে তারা। ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন তাদের ‘রাহবার’ এখন। অথচ কিছুদিন আগেও আমেরিকা নামে তারা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠত।

আড়াইশ বছরের পুরনো পারসিক রাজতন্ত্রের পতন ঘটে সৈয়দ রুহুল্লাহ মুসাবি খোমেইনি ওরফে আয়াতুল্লাহ খোমেনির মাধ্যমে। ইরানের সর্বশেষ শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি নাকি বলেছিলেন, ‘আমেরিকা যার বন্ধু হবে, তার শত্রু লাগে না।’ সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেজা পাহলভির বলা কথাটাও বলতেন। সজীব ওয়াজেদ জয়ের ‘লেটস টক’ অনুষ্ঠানে পাহলভিকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশের বেলা নাক গলায়। ইরানে শাহ পাহলভির যখন পতন হয়, তিনি একটা কথা বলেছিলেন— আমেরিকা যার বন্ধু হবে, তার শত্রু লাগে না।’ সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘আমেরিকায় মানুষের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু তারা অন্য জায়গায় এসে খবরদারি করে। এই মোড়লিপনা যে তাদের কে করতে দিল, আমি সেটি জানি না। আমি এ বিষয়টি সবার আগে আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরেছি এবং প্রতিবাদও করেছি।’ অথচ ভাগ্যের কী পরিহাস সেই আমেরিকা ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে এখন তাকিয়ে আওয়ামী লীগই, তারা চাইছে মোড়লগিরির প্রত্যাবর্তন।

১০ নভেম্বরের কর্মসূচি থেকে দৃশ্যমান লাভ আওয়ামী লীগ খুঁজছে বলে মনে হচ্ছে না। তারা চেয়েছিল ক্ষমতাহারা হওয়ার তিন মাস পর তাদের নেতাকর্মীরা কীভাবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার সেটা দেখাতে। এখান থেকে তারা যা চাওয়ার তার কিছুটা পেয়েছে। এই রাজনীতি করতে অভ্যস্ত দলটি; এই অনুশীলন সামনের দিনগুলোতে আরও দেখা যেতে পারে। লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট