জানুয়ারি ২৩, ২০২৫
লেডিঞ্জে গ্রেন্ড, স্টকহোম,সুইডেন
মতামত

রেজিম চেঞ্জ সম্ভব হয়েছে ছলনা, প্রতারণা, প্রোপাগান্ডা ও সহিংসতায়!

মাসুদ রানা : দিন শেষে প্রশ্নটা যুদ্ধ-প্রযুক্তির এবং প্রযুক্তি নির্ভর কৌশলের, বা স্ট্রাটেজির। প্রযুক্তি মানে কিন্তু শুধু হার্ড ওয়ার নয়, সফট ওয়ারও।
বৃটিশের গাঁদা বন্দুকের সামনে, আদিবাসী বা বাঙালির বর্শা বা ঢাল তলোয়ার টিকতে পারেনি। তেমনি, বিভক্ত কর ও শাসন কর, তথা শত্রুকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিভ্রান্ত করা ও মনোজগৎ দখল করার কাজটি চলে সফট পাওয়ার, জ্ঞানের ক্ষমতায়, অনেক সময়ই মিথ্যাচার ও প্রোপাগান্ডা দিয়ে। সফট পাওয়ার মোকাবেলা করার জন্য দরকার ঘিলু, গুণ্ডামি, জ্বিহাদী জোশ বা পেশীশক্তি নয়।
পুরো আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার অনেক দেশ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নিয়ত্রনে শুধু সামরিক শক্তিতে নয়। জ্ঞানের ক্ষমতায়, সফট পাওয়ার দিয়ে, সহজ নিয়ন্ত্রন। ‘ইসলামী’ রাজনীতি পুরোটাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তৈরি, কোল্ড ওয়ারের সময়ে, সমাজতন্ত্রের বিপক্ষে, সফট পাওয়ার কৌশলের অংশ। কি সেই কৌশল?

মুসলমানদের ধর্মীয় আত্মপরিচয় রাজনীতি দাও, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা দাও, এরা নিজেরাই ‘শ্রেণী-রাজনীতি’ থেকে দুরে সরে যাবে। ফলে কি হবে? ‘মুসলমানেরা’ অস্ত্র ও বিলাস পণ্যের বাজারের ভোক্তা হবে। ধর্মজীবী শ্রেণীর উদ্ভব হবে। নারীরা গৃহবন্দী হবে ও প্রতি বছর বাচ্চা দিয়ে পুঁজিবাদের জন্য প্রয়োজনীয় কায়িক শ্রমের জোগান দেবে। মধ্যপ্রাচ্যে ও অন্যান্য দেশে জ্বিহাদ উস্কে দিয়ে ভু-রাজনীতির স্বার্থ রক্ষা হবে। ধর্মান্ধতা উস্কে দিয়ে, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা থেকে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে দুরে রেখে নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বজায় রাখা যাবে।

‘ইসলাম ভার্সেস ওয়েস্ট’, ‘এন্থ্রপলজি অফ ইসলাম’, ‘জ্বিহাদ ও শ্রেণীসংগ্রাম, এবং ‘রিভারাইন ইসলাম’ – ইত্যাদি সবটাই সাম্রাজ্যবাদী ‘সফট পাওয়ার’ এর প্রকাশ।ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক আত্মপরিচয় রাজনীতি। শুধু ওয়াজ মাহফিল বা মাদ্রাসা শিক্ষা নয়, নানা উছিলায়, ‘ইসলামী’ আত্মপরিচয় সাম্রাজ্যবাদী জ্ঞানের ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত। চূড়ান্ত বিচারে, বাংলাদেশে রাজাকার আলবরদের রাজনীতি এবং এদের মুরুব্বী মার্কিন সাম্রজ্যবাদের বিশ্ব-আধিপত্য রক্ষার সফট পাওয়ার কৌশলের সেবা করে। মুখে ‘ইহুদী নাসারার’ বিরুদ্ধে বলবে, কিন্তু ‘ইসলামী’ অর্থনীতি ও জীবন বিধানের নামে পুঁজিবাদ বহাল রাখবে।
বাম কর্মীটিও যখন হিজাবকে বৈধতা দেয়, নয়া উদারবাদের সন্তান স্বৈরাচারকে ‘ফ্যাসিবাদ’ বলে পোস্ট দেয়, মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যখন অসম্মানজনক প্রোপাগান্ডায় অংশ নেয়, নাট্যকার মামুনুর রশিদ, শাহরিয়ার কবির ও মুহম্মদ জাফর ইকবাল ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের বিপক্ষে অবস্থান নেয়, জামাতকে আওয়ামীলীগের সমান্তরালে আনে, তখন আমি জেনে যাই, প্রতিক্রিয়াশীল ‘সফট পাওয়ার’ বাঙালির মগজ দখলের কাজটিতে অনেকদূর এগিয়েছে। ফলে, রাজাকার আলবদরের রাজনীতির সাফল্য অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

রেজিমচেঞ্জ সম্ভব হয়েছে কম্বিনেশন অফ সফট এন্ড হার্ড পাওয়ার এর ফলে। ‘ছলে, বলে, কলে, কৌশলে’ পন্থায়। ছলনা, প্রতারণা, প্রোপাগান্ডা ও সহিংসতায়। আপনি নিজেকে প্রগতিশীল ভাবতে পারেন, কিন্তু অতিসরল (Naive) বা মাথামোটা হলে, আপনি হারবেন। শুধু হারবেন না, পরোক্ষে রাজাকার আলবদরের রাজনীতির টুলস হবেন।

জ্ঞানের ‘ডি-কলোনাইজেশন’ কাজটি জটিল ও কঠিন, কিন্তু এই কাজটি না হলে জাতি হিসেবে বাঙালি পরাজিত হতে থাকবে। মানুষ হিসেবে বাঙালির ‘অ-মানবিকায়ন’ হতে থাকবে। রেজিমচেঞ্জের ডামাডোলে পরিবার বিভক্ত হবে, বন্ধু শত্রু হবে, এবং তলিয়ে যেতে থাকবে সামাজিক ঘৃণা ও সহিংসতার ঘুর্নাবর্তে।

বাঙালির ‘জাতীয় মুক্তির’ প্রশ্নটি নতুনভাবে সামনে এসেছে, যা এখন শ্রেণীমুক্তি, নারীমুক্তি ও পরিবেশ রক্ষার সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। সেটি সম্ভব ব্যবস্থাবদলের রাজনীতিকে বিকশিত করে। মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার ভিত্তি ভূমিতে দাঁড়িয়ে, প্রধানত জ্ঞানের ক্ষমতায়। লেখক: গবেষক। ফেসবুক থেকে