জানুয়ারি ২৩, ২০২৫
লেডিঞ্জে গ্রেন্ড, স্টকহোম,সুইডেন
বাংলাদেশ

‘মেটিক্যুলাস প্ল্যান’র বিপরীতে ভুল না করলে জুলাই-আগস্টের বিশৃঙ্খলা ঘটতো না দেশে

কবির য়াহমদ : আওয়ামী লীগের মধ্যে অনুশোচনার প্রবণতা দেখছি না। ষোলো বছরের দেশশাসনে কোনো ভুল করিনি—এমন একটা বিশ্বাস এখনো দলীয় সকল নেতাকর্মীর। শেখ হাসিনা কোনো ভুল করতেই পারেন না—এমন প্রচারণা ছিল আগে, এখনো নিজেদের মধ্যে এই বিশ্বাস আছে।

অথচ ‘মেটিক্যুলাস প্ল্যান’-এর বিপরীতে ভুল না করলে জুলাই-আগস্টের বিশৃঙ্খলা ঘটত না দেশে। অগণন সাধারণ মানুষ ও পুলিশ সদস্যের প্রাণহানি এবং সরকারি সম্পদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হতো না।

আগে বিএনপির নেতাগোত্রীয়দের আওয়ামী লীগ সরকার দৌড়ের ওপর রেখেছিল। সেই হিসেবে সাধারণ নেতা ও সাধারণ কর্মীসমর্থকেরা ছিল অনেকটাই নিরাপদ। আওয়ামী লীগের দেখানো সেই পথ ধরে এখন অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের নেতাদেরই কেবল নয়, একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের কর্মীদেরও ছাড় দিচ্ছে না। নির্মূলের লক্ষ্য তাদের। এই লক্ষ্য কেবল আদর্শকেই নির্মূল নয়, এই লক্ষ্য মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকারকেও কেড়ে নেওয়ার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

আগে সরকারি যে কোনো অগ্রহণযোগ্য কিছুর সমালোচকের অভাব ছিল না দেশে। সুশীল সমাজ নামের একটা শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু সেই সুশীল সমাজ এখন নেই; তারা সরকারের অংশ হয়ে গেছে; রচিত হয়েছে সুশীলতার গণকবর, এবং সমাধিসৌধের এপিটাফে এখন গোটা গোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে—’রাষ্ট্র সংস্কার চলছে’!

সংস্কার শব্দটি প্রথম দিকে খানিকটা জনপ্রিয়তা পেলেও এখন সেই জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারছে না। একদিক সংস্কার-সংস্কার জপ ও ক্ষমতার দম্ভ আর অপব্যবহার, অন্যদিকে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে দেশজুড়ে চলছে মব ইনজাস্টিস, নীরব দুর্ভিক্ষ, ঘটতে চলেছে মানবিক বিপর্যয়। এমন অবস্থায় কেউ কেউ বলতেও শুরু করে সংস্কার দিয়ে কি পেট ভরে? সত্যি ভরে না!
অনভিজ্ঞ সরকার দেশ পরিচালনায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে এটা বাজার পরিস্থিতি, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখেই অনুমান করা যায়। তারা রাজধানী ঢাকাকেই কেবল নিজেদের দখলে রাখতে পেরেছে, অন্য সব নিয়ন্ত্রণহীন। যার খেসারৎ দিতে হচ্ছে জনতাকে।
সরকারের এই অবস্থায় প্রকৃতই লাভবান হচ্ছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় না থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিএনপি। কারণ অন্তর্বর্তী সরকারকে অনেকেই বিএনপির ‘বি-টিম’ বলে মনে করছে; যদিও এই মনে করার মধ্যে প্রশ্ন আছে, তবু দুই দলীয় রাজনৈতিক শক্তির দেশে মানুষের মনোজগতে কেবলই আওয়ামী লীগ আর বিএনপি; অন্যরা এখানে অনেকটাই অনুল্লেখ্য।

সোয়া দুই মাসের অন্তর্বর্তী সরকারের নানা আলোচিত-সমালোচিত কর্মকাণ্ডে মানুষের মধ্যে হতাশার দেখা মিলছে। এতে আওয়ামী লীগ চাঙ্গা হচ্ছে। অথচ এই সময়ে দেশ পরিচালনায় সরকার যদি জনকল্যাণমুখী উদ্যোগ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে বাজার ও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো এবং বাংলাদেশের ইতিহাস পালটে দেওয়ার মতো আত্মঘাতী নানা পদক্ষেপ না নিতো তবে আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের বিরূপ ধারণা আরও পোক্ত হতো।

বর্তমানে নানা বিষয়ে যা হচ্ছে তাতে স্বভাব প্রশ্ন—যে ‘মেটিক্যুলাস প্ল্যান’-এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বিদায় হয়েছিল, সেই পথ ধরে পাল্টা কোন ‘মেটিক্যুলাস প্ল্যান’-এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কি চলছে? জুলাই-আগস্টে দেশে কোন বিপ্লব হয়নি, তাই প্রতিবিপ্লব নিয়ে আলোচনা অর্থহীন। অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে থাকা অনেকেই হয়ত এমন এক অবস্থার সৃষ্টিতে আছে, যাতে মানুষ বলতে বাধ্য হয়—ফ্যাসিজমের কড়া ডোজ চলমান!

ইত্যাকার দেশ পরিস্থিতি আওয়ামী লীগকে ক্রমে সুবিধাজনক অবস্থার দিকে ঠেলছে। পরের নির্বাচনেই হয়ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার অবস্থায় যেতে পারবে না, বা যেতে দেওয়া হবে না; তবে এমনটা চলতে থাকলে আওয়ামী লীগকে খুব বেশিদিন অপেক্ষাও করতে হবে না।

অন্তর্বর্তী সরকারের নানা পদক্ষেপে মনে হতে পারে আওয়ামী লীগ এখন কোণঠাসা, কিন্তু দৃশ্যমান কোণঠাসা অবস্থানের বাইরে বিতর্কিত নানা কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগকেই ফিরে আসার পথ খুলে দিচ্ছে। এখন আওয়ামী লীগের দরকার অনুশোচনা; কী ভুল করেছে তারা সেটা খুঁজে বের করা এবং সে অনুযায়ী শুদ্ধিকরণ অভিযান ও ক্ষমা চাওয়া। ক্ষমা মহত্বের লক্ষণ, আর বাঙালি চিরকাল মহৎ হতেই চেয়েছে। লেখক:সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ফেসবুক থেকে