ফজলুল বারী : একাত্তরের আগরতলার নানান কাহিনী খুঁজতে গিয়ে বাংলাদেশের যে সব রাজনৈতিক নেতাকে নিয়ে সেখানকার জনপ্রিয় গল্পগুলো শুনি তাদের একজন মতিয়া চৌধুরী। চীন-রাশিয়ার দ্বন্দ্বে ছাত্র ইউনিয়ন ভেঙ্গে মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে দু’ভাগ হয়। দু’ভাগই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। মতিয়া চৌধুরী তখন আগরতলার মোড়ে মোডে শরণার্থী যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উৎসাহিত করতে পথসভা করতেন। স্থানীয় লোকজনকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলতেন, আমাদের জন্য আপনারা যত কষ্ট স্বীকার করছেন এটা বাংলাদেশ ভুলবেনা। তাদের কাছেও তিনি তখন অগ্নিকন্যা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ছাত্র ইউনিয়নের মতিয়া গ্রুপ সিপিবির ছাত্র সংগঠন হয়। মেনন গ্রুপ ভাসানী ন্যাপ হয় চলতি ওয়ার্কার্স পার্টি সহ বহুধা বিভক্ত। অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী হয়ে গেলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী। এরশাদ ও খালেদা জিয়া বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে লড়াকু ভূমিকায় আমরা তাঁকে দেখেছি। কতবার যে তিনি পুলিশের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন! হরতাল অবরোধে নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজপথে মুনাজাতে বসে যেতেন! খুব সাধারন ছিল তাঁর বেশ ভূষা। সাধারন শাড়ি পরতেন। স্বামী প্রভাবশালী সাংবাদিক বজলুর রহমান। এটা নিয়েও তাকে কোনদিন কেউ আলাদা দাপট দেখাতে দেখেননি। একবার নেত্রকোনার কোন একটি এলাকার উপনির্বাচনের প্রচারে গিয়ে কয়েকদিন ছিলেন। সেখানে এক বাড়িতে তার সঙ্গে দেখা হয়। পরিচয় পেয়ে আমার একটি রিপোর্ট নিয়ে ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া দেখান। সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ সেখানে ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে মনসুর ভাইকে বিব্রত দেখায়। এটাই মতিয়া চৌধুরী। কারো সংগে তোয়াজ করে কথা বলতেননা।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি মন্ত্রী হন। পার্বত্য শান্তি চুক্তির বিরুদ্ধে স্থানীয় বাঙালিদের প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে গোটা পার্বত্য এলাকা তখন উত্তপ্ত। মতিয়া চৌধুরী পথসভা করে করে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন। তখন সার্কিট হাউসে তার সাধারন জীবনযাপন এলাকায় আলোচিত ছিল। সেখানে তার খাওয়াদাওয়ার বাজার খরচের টাকাও তিনি নিজে পরিশোধ করতেন। ১/১১’র সরকারের সময় অনেক রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। মতিয়া চৌধুরীকে তখন দেখা যেত বিডিআর এর লাইনে দাঁড়িয়ে কম টাকায় খাদ্য সামগ্রী কিনছেন। ইনিই মতিয়া চৌধুরী। কারোয়ান বাজার, শান্তিনগর বাজারেও তিনি নিজে কাঁচাবাজার করতেন। বাজারের ময়লা পানি এড়াতে রাবারের জুতো পরে নিতেন।
শেখ হাসিনা তাঁকে অনেক সম্মান সহ ডাকতেন মতিয়া আপা। সর্বশেষ তাকে সংসদ উপনেতাও করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটানোর পর অনলাইনে নানানজনের নাম আসছিল। কাকে দু:সময়ে দলের নেতৃত্ব দেয়া যায়। আমি মনে মনে তাঁর কথা ভাবতাম। কিন্তু তিনি যে এত অসুস্থ ছিলেন জানতাম না। তাঁর মৃত্যুর খবরে শোকার্ত হয়েছি। বাংলাদেশের কোন সরকারি ব্যক্তিত্ব এই বীর মুক্তিযোদ্ধা নেত্রীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেননি! কারণ এরা কারা তা এরমাঝে জনগণের কাছে প্রকাশিত। একাত্তর পঁচাত্তরের খুনিদের ধারকবাহক-বংশধরদের কাছে বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিয়া চৌধুরীর সম্মাননা চাই না। অনেক ভালো থাকবেন আপা। আপনি একজন সৎ মানুষ ভালো মানুষ ছিলেন। লেখক : অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক। ফেসবুক থেকে