জানুয়ারি ২৩, ২০২৫
লেডিঞ্জে গ্রেন্ড, স্টকহোম,সুইডেন
মতামত

স্বঘোষিত হন্তারকের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেবে রাষ্ট্র?

কবির য়াহমদ : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম বলেছেন, ‘যদি মেট্রোরেলে আগুন না দেওয়া হতো, যদি পুলিশদের না মারা হতো তাহলে এই বিপ্লবটা এত সহজে অর্জিত হতো না। ফ্যাসিবাদের পতন নিশ্চিত করা যেত না।’
গত ২৬ অক্টোবর বেসরকারি টেলিভিশন ডিবিসির ‘প্রযত্নে বাংলাদেশ’ টকশোতে এই মন্তব্য করেন সমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম। এই মন্তব্যের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হাসিব আল ইসলামকে তিন দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছে।

সংগঠনটি কী ব্যবস্থা নেয় না নেয়, এটা খুব জরুরি কিছু নয়। বরং এটা অরাজক এক অবস্থা, যেখানে একজন সমন্বয়ক টেলিভিশন চ্যানেলে এসে প্রকাশ্যে অনেকটা দাম্ভিকতার সঙ্গে বিশ্ববাসীকে জানাচ্ছেন তাদের নাশকতার কথা। এখানে তিনি বিন্দুমাত্র বিব্রত হননি, অনুশোচনা ছিল না তার মধ্যে, বরং ছিল বিজয়ীর অনভিপ্রেত স্বর।

পুলিশ বা মানুষ হত্যার প্রকাশ্য ঘোষণা দেওয়া ও স্বীকারোক্তির নজির খুব বেশি থাকে না। অনএয়ারে বিশ্ববাসীর সামনে এভাবে মানুষ হত্যার নারকীয় বর্ণনা কীভাবে দেওয়া সম্ভব? এই নারকীয়তামূলক স্বীকারোক্তির পর এখন কী ব্যবস্থা নেয় রাষ্ট্র–তাই এখন দেখার বিষয়।
নির্বাহী আদেশে, ১৬ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের কৃত সকল অপরাধের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। মানুষ বা পুলিশ হত্যার এই দায়মুক্তি হাসিব আল ইসলামরা পেয়ে বসে আছেন। তাই মানুষ হত্যার ঘটনার ফলাও করে দাম্ভিক স্বীকারোক্তি তারা দিতে পারছেন। কিন্তু সত্যি কি মানুষ হত্যার দায়মুক্তি সম্ভব? ফৌজদারি অপরাধ তামাদি হয় না তো জানি!

মেট্রোরেলে আগুনের ঘটনার পর ওই সময় একাধিক লেখায় লিখেছিলাম, ছাত্ররা এমন নাশকতা করতে পারে না। প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সে কথাগুলো বলেছিলাম। হাসিব আল ইসলামের দম্ভ ও স্বীকারোক্তির পর বুঝতে পারছি–আমরা ভুল ছিলাম। ছাত্র হিসেবে মানুষ হত্যার মতো অপরাধ সংঘটনে তারা করতে পারেই না, এমন বিশ্বাস ছিল ভুল। হাসিব আল ইসলামের সাম্প্রতিক বক্তব্য তার প্রমাণ।
হাসিব আল ইসলাম যা বলেছেন সেটা একান্ত কোন আড্ডায় বলেননি, বলেননি কোন বন্ধুর কাছে। তিনি বলেছেন প্রকাশ্যে, তাও আবার একটি টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এসে। তিনি জানেন এই অনুষ্ঠান দেখবে সারা দেশের মানুষ, দেখবে বিশ্বের অনেকের। তার বক্তব্যকে ‘ডিপ ফেইক’ বলে অস্বীকারের উপায় নাই, কারণ এর শ্রোতা যেমন আছেন অগণন লোক, তেমনি ছিলেন টকশোর সঞ্চালক ও অন্য আমন্ত্রিত বিএনপি নেত্রী নিলুফার চৌধুরী মনি।

আন্দোলনকারীদের কর্তৃক অপরাধ নিয়ে কোন মামলা করা যাবে না, এমনই এক নির্বাহী আদেশ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই মানুষ হত্যার বিষয়টি তদন্ত শেষে প্রমাণসাপেক্ষ বিষয় বলে তাদের দায়মুক্তিকে বড় অপরাধ হিসেবে দেখার সুযোগ ছিল বিতর্কসাপেক্ষ, তবে কেউ যখন প্রকাশ্যে জাতির সামনে এসে বলে বিজয়ী হতে আমরা মানুষ মেরেছি-ধর্মী কথা, তখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব হয়ে পড়ে স্বঘোষিত হন্তারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের। এটা করতে রাষ্ট্র যদি ব্যর্থ হয়, এটা করতে রাষ্ট্র যদি অপারগতা প্রকাশ করে, অনাগ্রহ দেখায়, অগ্রাহ্য করে; এটা ব্যর্থ রাষ্ট্রের অনুরূপ হয়ে পড়ে।
জুলাই-আগস্টের আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী আন্দোলনে যত লোক নিহত হয়েছেন, তাদের প্রতি আমরা সহমর্মী। স্বাভাবিকভাবেই আমরা এর বিচার চাইছি। কিন্তু পুলিশ হত্যার বিরুদ্ধে কেন সহমর্মী হব না? তাদেরকে কি আমরা মানুষ হিসেবে মনে করব না? কেন করব না?

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হিসাবে প্রায় দেড় সহস্র মানুষের মৃত্যু নিয়ে আলোচনা আছে, বিচারের দাবি আছে, উদ্যোগও আছে। কিন্তু কোন কথা নাই পুলিশ হত্যা নিয়ে। তাদের আমরা কী বিবেচনায় মানুষের খাতা থেকে তাদের মুছে দিলাম? কেন দিলাম, কোন যুক্তিতে? এই দেড় সহস্র মানুষের মৃত্যুতে যারাই দায়ী হোক সেই দায়ীদের কেউ প্রকাশ্যে এসে খুনের স্বীকারোক্তি দিচ্ছে না, অথচ দেখুন প্রকাশ্যে এসে দম্ভের সঙ্গে পুলিশ হত্যার স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন একজন সমন্বয়ক। কিন্তু তবু এনিয়ে কিছুই বলছেন না স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, সরকার।

চাইলে অপরাধ আড়াল করা যায় কেউ দেখিয়ে না দিলে, কিন্তু কেউ যদি প্রকাশ্যে এসে জানায় মানুষ হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের কথা, তখন কোন দায়মুক্তির সুযোগ থাকে না। রাষ্ট্র তখন বাধ্য হয়ে যায় কথিত দায়মুক্তি এড়িয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের। তা না হলে মানুষ হত্যা ছেলেখেলা হয়ে যাবে। দেশে আইন-আদালত বলতে কোন কিছু থাকে না। জোর যার মুলুক তার, এটা ঘটনাক্রমে বাস্তবতা হলে এটাকে প্রাতিষ্ঠানিক করা যাবে না; কোনোভাবেই না!

আপনি যে পক্ষেরই হোন না কেন, দয়া করে মানুষের পক্ষ হোন, মানুষ হত্যার স্বঘোষিত হন্তারকের দাম্ভিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ান। হন্তারক হন্তারকই; তার বাকি পরিচয় গৌণ এখানে। হাসিব আল ইসলামকে কেউ আগে থেকে হন্তারক দাবি করেনি, তিনি নিজেই এসে দাবি করছেন। তিনি নিজেই নিজেদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছেন। এমন দাবির পরেও যদি কেউ না দাঁড়ায়, রাষ্ট্র যদি কোন ব্যবস্থা না নেয়, তবে এরচেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটিকে ধন্যবাদ তারা অন্তত কারণ দর্শাতে বলেছে। তারা আড়ালে পড়তে যাওয়া আলোচনাকে সামনে এনেছে। এখন এটাকে না গিলে ফেললেই হয়! লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ফেসবুক থেকে