গৌতম চক্রবর্তী : আমাদের ছোটবেলায় কপিলদেব ছিলেন। আর ছিলেন গাভাস্কর। ভুল বললাম, ছিলেন অনেকেই; বিশ্বনাথ অমরনাথ বেঙ্গসরকার রবি শাস্ত্রী মদনলাল দিলিপ দোশি। কিন্তু আমাদের হিরো ছিলেন এই দুজনেই। এদের দেখেই এদের সামনে রেখেই আমরা ব্যাট বল ধরতাম। অনুসরণের চেষ্টা করতাম প্রাণপণ।
ওপেনে গাভাস্কার মানেই বিপক্ষের প্রবল মাথাব্যাথা। তা সে যে দল বা যে ধরনের পিচই হোক। সেই মার্শাল রবার্ট লিলির যুগে হেলমেট সরিয়ে স্রেফ স্কাল ক্যাপ পরে বাউন্সি উইকেটে অনায়াস মস্তানি, যেকোনো বিপক্ষের শ্রদ্ধা আদায় করে নিত। তখনও ওয়ানডে আসেনি, টি-২০ তো অনেক দূরের কথা। ক্রিকেট তখন অন্য ধরনের খেলা ছিল। পিচে বোলার অনেক বেশি সাহায্য পেত সেই সময়। সফল হওয়ার একটাই মন্ত্র ছিল তখন, প্রবল মনোঃসংযোগ আর অসম্ভব ধৈর্য্য। ওপেনার হিসাবে বল মারার থেকে ছেড়ে দেওয়ায় অনেক বেশি পটু ছিলেন তিনি। বিপক্ষকে হাঁপিয়ে দেওয়া, প্রতিটি বলের মেরিট অনুযায়ী খেলা; সুনীল গাভাস্কার ছিলেন একজন আদর্শ টেস্ট ওপেনার। আজকের দিনেও বিশ্বের সর্বকালের সেরা টেস্ট দলে তাঁর অনিবার্য উপস্থিতি থাকবে। আমরা যারা গাভাস্কারের খেলা দেখেছি, তাঁরা এটা জানি।
গাভাস্কার যদি নিঃশব্দ ঘাতক হন, কপিল ছিলেন বেপরোয়া দুঃসাহসী রংবাজ। বল হাতে ভারতের হয়ে ওপেনিং স্পেল মানেই আমরা জানতাম উইকেট আসছে। শুনেছি এক সময় নাকি বলের পালিশ তোলার জন্য নতুন বলে গাভাস্কার পর্যন্ত বল করেছেন। আমাদের বোলিং আক্রমণ বলতে শুধুই স্পিন। বেদী প্রসন্ন চন্দ্রশেখর বেঙ্কট্রমন এরাই ছিলেন কপিলদেবের পূর্বসূরি। কপিল প্রথম আমাদের পেস বোলিং হিরো। কারসন ঘাউরি আর কপিল তখন ওপেন করতেন। ঘাউড়ি বাঁহাতি মিডিয়াম পেসার, দলের প্রয়োজনে নাকি স্পিনও করতেন। কিন্তু কপিল ছিলেন জেনুইন পেসার। তাঁর আউট সুইঙ্গারের ফাঁদে কত বিখ্যাত ব্যাটসম্যান যে প্যাভিলিয়ানের রাস্তা দেখেছেন, তার হিসাব নেই। সাথে অসাধারণ ৬ নম্বর ব্যাটসম্যান। ৮৩ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে কপিলের ১৭৫ নট আউট ইনিংসটি না দেখার আক্ষেপ আমাদের জেনারেশন আজীবন বইবে। কপিল ছিলেন ভারতের প্রথম জেনুইন অলরাউন্ডার। গাভাস্কার একবার বলেছিলেন, ‘কপিল যে কত বড় ব্যাটসম্যান তা সে নিজেও জানে না’। আর একবার গাঙ্গুলি ওয়ানডে বিশ্বকাপের পরে বলেছিল, ‘আমার যদি একটা কপিল থাকত…’। কপিলদেব রামলাল নিখঞ্জ দুনিয়ার সর্বকালের সেরা টিমে ঢোকার অন্যতম দাবিদার। আর ভারতের সর্বকালের সেরা টেস্ট ওয়ানডে বা টি-২০তে অনায়াস অন্তর্ভুক্ত হবেন। হ্যাঁ, আজকের যুগের এই ধুমধারাক্কা ক্রিকেট দেখার পরেও বলছি।
ক্রিকেটে ভারতের উদয় কিন্তু এই দুজনকে সামনে রেখেই। শচীন থেকে শ্রীনাথ, দ্রাবিড় লক্ষণ থেকে জাহির; সবাই কিন্তু এদের সামনে রেখেই বেড়ে উঠেছেন। আর এর পরে তো এক ঝাঁক তারকা। আমাদের দেশ এখন অনায়াসে দুটো বিশ্বমানের টিম নামিয়ে দিতে পারে ক্রিকেটের যেকোনো ফরম্যাটে। এক মাত্র অস্ট্রেলিয়া ছাড়া আর কোনো দল এমন করতে পারে বলে জানা নেই। ক্রিকেটে ভারতের মস্তানি শুরুর রাস্তাটা প্রকৃত অর্থে এরাই বানিয়ে গেছেন।
আমাদের এই উপমহাদেশের অন্যতম একজন সেরা ক্রিকেটারের টেস্ট ক্যারিয়ার সম্ভবত শেষ হচ্ছে। অন্তত বিদেশের মাটিতে তাঁর শেষ টেস্ট ম্যাচ ছিলো ভারতের বিপক্ষে। আমাদের গাভাস্কার কপিলদেবের মতোই যাকে দেখে বাংলাদেশের অগুন্তি তরুণেরা ক্রিকেটার হবার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন। আজকের মেহেদি, শান্ত অথবা লিটন বা আগামীর কোনো অজানা তারকা হয়তো সাকিব আল হাসান হবার স্বপ্নেই ক্রিকেটের ব্যাট বল হাতে তুলে নিয়েছেন। সাকিব আল হাসান, বাংলাদেশের প্রথম জেনুইন অলরাউন্ডার ও বিশ্বমানের ক্রিকেটার। বিশ্ব ক্রিকেটের লেজেন্ডদের সাথে যার নাম উচ্চারিত হয়। হবেও আগামী দিনে। সাকিব ছাড়া বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের এক লাইনও লেখা সম্ভব নয়। আপনাকে ধন্যবাদ সাকিব, একজন বিরাট ক্রিকেটার একজন ভয় ধরানো প্রতিদ্বন্দ্বী, একজন ক্রিকেট লেজেন্ড যিনি তাঁর খেলা দিয়ে আমাদের বহুবার বিনোদন দিয়েছেন। বিদায় সাকিব, আপনার আগামী শুভ হোক। একজন ক্রিকেট ফ্যান হিসাবে আপনাকে আমি আজীবন মনে রাখব।
সূত্র : https://www.facebook.com/gautam.chakraborty.5477
Leave feedback about this