জানুয়ারি ২৩, ২০২৫
লেডিঞ্জে গ্রেন্ড, স্টকহোম,সুইডেন
বাংলাদেশ মতামত

শেখ হাসিনা কি ট্রাভেল ডকুমেন্ট পাওয়ার পরে আট-দশটি দেশে যাচ্ছেন?

মনজুরুল হক : ৮ আগস্ট ক্ষমতাসীন হয়ে ইউনূস সাহেব আর তার উপদেষ্টাগণ তের দিনের মাথায় শেখ হাসিনার ডিপ্লোম্যাটিক লাল পাসপোর্ট বাতিল করে দিলেন। ভাবলেন; হাসিনা আর দেশে তো ফিরতে পারবেনই না, এমনকি ভারত ছেড়ে কোথাও যেতেও পারবে না। আবার ভারতেও থাকতে পারবে না, কারণ ইউনূস সাহেব ভারতীয় সংবাদমাধ্যম-পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভারতকে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন-‘আমরা হাসিনাকে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করব। তিনি ভারতে থাকতে চাইলে তাকে চুপ করে তাকতে হবে’, কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়া যাবে না।’
♠️
বুড়িগঙ্গার নোংরা জল আরও দক্ষিণে গড়ানোর পরে ইউনূস সাহেবের মৌসুমী তল্পিবাহকেরা বলবর্ধ্বক বটিকা সেবন করে তীব্র ভাষায় হাসিনাকে জড়িয়ে ভারতকে হুমকি-ধামকিও দিচ্ছিলেন। কেউ কেউ আবেগের আতিশয্যে ব্যঙ্গবিদ্রুপও করছিলেন সামাজিক মাধ্যমে। তাদের তড়পানো দেখে মনে হচ্ছিল হাসিনা শুধু দেশ ধ্বংস করেনি, এখন ভারতেরও ‘গলার কাঁটা’। ভারত তাকে এই বের করে দেয় তো সেই বের করে দেয়। তখন কোথায় যাবেন ‘স্বৈরাচারী হাসিনা’? এই পুলকে অনেকেই হাসিনার সম্ভাব্য করুণ প্রতিচ্ছবি কল্পনা করে বিজাতীয় আনন্দও পাচ্ছিলেন। এক ইউটিউবার বুদ্ধিব্যাপারি তো হাসিনাকে ‘ভারতের ক্রীতদাস’ বলে দিলেন!
♠️
এই নতুন পানির তড়পানো মাছেরা জানতেন না ভারত হাসিনাকে এর আগেও ছ’বছর যথাযথ মর্যাদায় আশ্রয় দিয়েছিল। এবারও যথাসময়ে হাসিনাকে আশ্রয় দেয়নি শুধু, তাকে এয়ারফোর্সের নিরাপত্তা জোনে ওয়েল প্রোটেকটেড একটা বাড়িতে রাখা হয়েছে। তার সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য দুজন সার্বক্ষণিক নারী সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন সিভিল ড্রেসে। আর এই পুরো সিদ্ধান্তটি বিজেপি সরকারের একার নয়, বরং সর্বদলীয় সিদ্ধান্ত।
♠️
অবশেষে সেই সব দলের লিখিত সিদ্ধান্ত নিয়ে ভারত সরকার শেষ হাসিনাকে ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ ইস্যু করেছে। এটা আরও আগেই হতো, কিন্তু টিডিপি নেতা চন্দ্রবাবু নাইডু হাসপাতালে থাকায় তার লিখিত অনাপত্তিপত্র পেতে দেরি হয়েছে।
♠️
ট্রাভেল ডকুমেন্ট কী? এটা জাতিসংঘের সিটিজেন চার্টার নিয়ম মেনে ভারতের এক ধরণের নীল রঙের পাসপোর্ট বিশেষ। এই ডকুমেন্ট দেওয়া মানে অফিসিয়ালি ভারতীয় নাগরিকত্ব না দিলেও তিনি সর্বত্র ‘ভারতীয়’ হিসাবেই সুবিধা ভোগ করবেন। এই ডকুমেন্ট দিয়ে শেখ হাসিনা বিশ্বের যে কোনো দেশে যেতে পারবেন। এর বিশেষত্ব হলো প্রথমত: তিনি যে কোনো দেশের ভিসা চাইলে ভারত সেই ভিসার জন্য সুপারিশ করবে এবং দ্রুত ভিসা মিলবে। দ্বিতীয়ত: তিনি যে দেশেই যাবেন চার্টার বিমানে পূর্ণ নিরাপত্তা সুবিধা পাবেন। তৃতীয়ত: হাসিনা যে দেশেই যাবেন সেখানে হোটেল থেকে শুরু করে যাবাতীয় লজিস্টিক সাপোর্ট দেবে সেই দেশের ভারতীয় দূতাবাস। চতুথত: যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; হাসিনা যে দেশেই যাবেন সেই দেশ ভারতকে না জানিয়ে ভারতের অনুমতি ছাড়া হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরানো বা ওই ধরণের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। অর্থাৎ তিনি যেখানেই যান না কেন সেখানে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কিছু করার নেই। তিব্বতের ধর্মগুরু দালাই লামা সেই ১৯৫৯ সাল থেকে এরকমই ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে ভারতে আছেন এবং বিশ্বময় সফর করছেন।
♠️
এবার ভারত এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন-‘ভারত এটা করায় আমাদের কিছু করার নেই। এতে করে ভারতের সঙ্গে কিছু ঝামেলা থাকলেও আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখব।’
♠️
বিস্ময়কর হচ্ছে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এই উপদেষ্টা শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করবার জন্য সকাল-বিকাল ভারতকে ধুয়ে দিতেন। নরেন্দ্র মোদীকেও কড়া কড়া কথা শোনাতেন। এবার যখন হাসিনা ট্রাভেল ডকুমেন্ট পেয়েছেন, তখন তৌহিদ সাহেব স্পিক্টি নট! ইউনূস সাহেব যে তেজে পিটিআইয়ের মাধ্যমে ভারতকে হুকুমটুকুম দিচ্ছিলেন, তিনও চুপ। আর জামাত, আধা জামাত, সিকি জামাতিদের প্রগতিশীল ফ্যাকশনের অতি উৎসাহী তালেবররা রাগে-দুঃখে হাসিনাকে ‘ভারতের ক্রীতদাস’ বলে মনের ঝাল মেটালেন। এই সিকি জামাতি এখন সরকারকে ছবক দিচ্ছেন সরকার যেন হাসিনা যে দেশে যাবে সেই দেশে তাঁর সফরের বিরোধীতা করার চেষ্টা করে। এই অবোদা বুদ্ধিব্যাপারি নিয়ম-কানুন কিছুই জানেন না। জানলে এমন বালখিল্যতা দেখাতেন না। এবারও জনাবের কষ্ট লাঘব হবে না, কারণ ভারতীয় ডকুমেন্টধারী হাসিনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কিছুই করার নেই।
♠️
এবার ‘শাপে বর’ কথাটায় আসা যাক। অন্তর্বর্তী সরকার যদি হাসিনার পাসপোর্ট বাতিল না করত তাহলে কী হতো? হাসিনা তাঁর পাসপোর্ট নিয়ে যে দেশেরই ভিসার আবেদন করতেন, বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে ভিসা না দিতে অনুরোধ করতে পারত। হয়ত হাসিনা ইউনূস সাহেবকে সমর্থনকারী দেশের ভিসা পেতেন না। হয়ত যে দেশে তিনি যেতেন সেই দেশকে বাংলাদেশ তাকে দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করতে পারত। তখন ডিপ্লোম্যাটিক রুলসে ভারতেও কিছু করার থাকত না, কিন্তু এখন তো সে উপায়ও রইল না, কারণ হাসিনা কাগজে-কলমে ‘বাংলাদেশি’ নয় ‘ভারতীয়’ হিসাবে ভ্রমণ করবেন। সুতরাং পাসপোর্ট বাতিল তাঁর জন্য ‘শাপে বর’ হয়েছে বলা যায়।
♠️
এমতাবস্থায় ড. ইউনূস কী করতে পারেন? তিনি হয়ত আরও একটি কমিশন বসাতে পারেন যে সচিবালয়ে ‘হাসিনার লোক’ নেই তো, যারা তড়িঘড়ি পাসপোর্ট বাতিল করে হাসিনার জন্য ‘শাপে বর’ করে দিয়েছে?
♠️
গুজব উঠেছে হাসিনা ট্রাভেল ডকুমেন্ট পাওয়ার পরে আট-দশটি দেশে যাচ্ছেন। এটা গুজব। তবে এটা গুজব নয় যে শেখ হাসিনা ট্রাভেল ডকুমেন্ট পাওয়ার পর সময় নষ্ট করবেন না। সম্ভাব্য খবর-হাসিনা এ মাসের ২৪ তারিখে সফর শুরু করে প্রথম পর্বে চারটি দেশ সফর করবেন। ছেলের কাছে যুক্তরাষ্ট্র বা মেয়ের কাছে যুক্তরাজ্য নয়। তিনি প্রথমে যাবেন সুইজারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড কেন? কারণ তারা বিশ্বজুড়ে নিরপেক্ষ ও মধ্যস্থতাকারী দেশ হিসাবে সমাদৃত। জাতিসংঘের অনেক দপ্তরও ওখানে। তা ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন জোট, গোষ্ঠী, সংঘের দপ্তরও সু্জারল্যান্ডে। এরপর যাবেন ফিনল্যান্ড, তারপর আরব আমিরাত এবং সব শেষে তুরস্কে যাবেন। তার আগে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সম্ভবনা আছে। সেই সাক্ষাতে উপস্থিত থাকতে পারেন মোদী ছাড়াও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, অমিত শাহ এবং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। এই ট্রাভেল ডকুমেন্টের জোরে তিনি এবার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যে অগণতান্ত্রিক ও অবৈধভাবে তাকেঁ পদচ্যুত করে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে সেই বিষয়ে বিশ্বজনমত তাঁর পক্ষে আনার চেষ্টা করবেন এবং তাঁর দলের সমর্থকদের সংগঠিত করে প্রত্যাবর্তনের লড়াইয়ে ঝাঁপ দেবেন।
♠️
সবটাই অনুমান। তিনি কবে যাবেন, কেন যাবেন, ওইসব দেশে গিয়ে কী কী করবেন সবই অনুমান মাত্র। তবে তিনি ভারতের ট্রাভেল ডকুমেন্ট হাতে পেয়েছেন, তাঁর কাছে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগপত্র আছে এবং তিনি International Court of Justice (ICJ) এ মামলা রুজু করতে যাচ্ছেন যার কাগজপত্র তাঁর আইনজীবী ড. হরিশ সালভে সাক্ষর করে নিয়ে গেছেন এসব মোটেও অনুমান নয়।

-মিড অব অক্টোবর’২৪। লেখক ও ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট। ফেসবুক থেকে