জানুয়ারি ২৩, ২০২৫
লেডিঞ্জে গ্রেন্ড, স্টকহোম,সুইডেন
মতামত

রেজিম চেঞ্জ কী?

আজিজুর রহমান আসাদ : নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার বদল হতে পারে। কিংবা সুনির্দিষ্ট প্রকাশ্য দাবীর ভিত্তিতে জনগণের সকল শ্রেণী পেশার অংশগ্রহণে বিকশিত গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকার বদল হতে পারে। যেমন বাংলাদেশে ১৯৯০ এর গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক দলের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ছিল একটি ‘গণআন্দোলন’, যা তৎকালীন সরকার পতন ঘটায়। ভবিষ্যৎ রূপরেখা স্পষ্ট ছিল যে, নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন হবে।

কিন্তু ‘রেজিমচেঞ্জ’ একটি ভিন্ন রাজনৈতিক ধারনা ও কৌশল। এটিও ক্ষমতাসীন সরকার পতন ঘটায়, কিন্তু সত্যিকার সচেতন ‘গণআন্দোলনের’ কৌশল বা পন্থায় নয়। এটিকে এন্ড্রু করিবকো নাম দিয়েছেন ‘হাইব্রিড ওয়ার’। এটি সাধারণত ষড়যন্ত্রমূলক, প্রতারণামূলক, মূলত বাইরের (সাম্রাজ্যবাদের) সামরিক হস্তক্ষেপ, কূটনৈতিক চাপ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং স্থানীয় কোন আন্দোলনকে ম্যানিপুলেট করে সরকার পতন ঘটানো হয়।

‘রেজিমচেঞ্জ’ রাজনীতি তাই প্রধানত ষড়যন্ত্রমূলক, প্রতারণামূলক ও অনৈতিক।
১) কেন অনৈতিক? কারণ, এটি প্রতারণা ও ষড়যন্ত্র করে একটি দেশের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করে, নিজেদের গোপন বা প্রকাশ্য স্বার্থে। আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য নানা মিথ্যাচার ও প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত ও উত্তেজিত করে, নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করে। এর ফলে, বহিরাগত হস্তক্ষেপ স্থানীয় দ্বন্দ্বকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ জনগণ, এবং দেশকে দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক ফলাফলের দিকে নিয়ে যায়। এরা জনগণের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থের কথা চিন্তা করেনা, ফলে এরা নীতিহীন রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত।

২) রেজিমচেঞ্জের মুল প্রেরণা কি? মুখে বলা হয়, বৈষম্য বিলোপ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, স্বৈরাচার হটানো। আসল উদ্দেশ্য, ক্ষমতাসীন দলকে হটিয়ে রাষ্ট্রকে দুর্বল ও দেশকে অস্থিতিশীল করা, যাতে করে দুর্বল রাষ্ট্রটিকে দিয়ে অনেক বৈষম্য ও অধীনতামূলক গোপন চুক্তি করে নেয়া যায়। পুঁজিবাদী শোষণ ও সঙ্কটের মুল কারণ আড়াল করে ব্যক্তিকে দায়ী করা হয়, এবং সরকার বদলের মাধ্যমে শোষণমূলক ব্যবস্থা দির্ঘায়িত করা হয়। রেজিমচেঞ্জের ডামাডোলে ব্যবস্থাবদলের বিপ্লবী রাজনীতিকে জনমানস থেকে দুরে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়।

৩) কৌশল বা পদ্ধতি কি? প্রধানত প্রতারণা, মিথ্যাচার, প্রোপাগান্ডা, এবং চরম হিংসাত্মক উপায়ে সরকার বদল। এটি অহিংস নান্দনিক ও সৃজনশীল কৌশলের (যেমন, নাটক, গান, মোমবাতি, ফুলের আয়োজন) বা পদ্ধতিকে বাতিল করে দেয়, ফলে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের চক্র তৈরি হয়। রাজনীতি প্রতিহিংসা পরায়ণ ‘পুরুষের’ হাতে চলে যায়। সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তিকে সুযোগ দেয়, কূটনৈতিক স্বীকৃতি বা আন্তর্জাতিক সমর্থন গ্রহণের মাধ্যমে।

রেজিমচেঞ্জের ফলে কি ঘটে? সরকার পরিবর্তনের ফলাফল প্রায়ই অপ্রত্যাশিত হয়। সাধারণত দেশটি অস্থিতিশীলতা, গৃহযুদ্ধ বা কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিস্ট শক্তির হাতে চলে যায়। জনগণের অবস্থা খারাপ হতে থাকে এবং পরবর্তী অবস্থা প্রায়শই বাইরের শক্তি ও সমর্থনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পরে।

রেজিমচেঞ্জের ঐতিহাসিক উদাহরণ কি? উল্লেখযোগ্য উদাহরণগুলির মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক (২০০৩) এবং লিবিয়া (২০১১) আগ্রাসন। পাশাপাশি আরব বসন্তের মতো আন্দোলনের সমর্থন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এতে বিভিন্ন ধরনের লোকজন যুক্ত হয়, যারা নিজেরাও জানেনা কি পরিণতি অপেক্ষা করছে। যারা বিভিন্ন কারণে যুক্ত হয়, যেমন বেকারত্ব ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে ক্ষোভ, বিরোধী দলের সমর্থক, ক্ষমতাসীন সরকারকে ঘৃণা বা অন্য কোন যুক্তিতে, এরা প্রতারিত বোধ করে, এবং অনিশ্চয়তা ও হতাশার আবর্তে ঢুকে যায়।

রেজিমচেঞ্জের রাজনীতির বিপরীতে রয়েছে ‘ব্যবস্থা বদলের’ রাজনীতি। সাম্যবাদে বিশ্বাসীরা কখনো সাম্রাজ্যবাদী ‘রেজিমচেঞ্জের’ রাজনীতিতে অংশ নেয় না, ব্যবস্থা বদলের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকে। লেখক: গবেষক। ফেসবুক থেকে