ইউক্রেন যুদ্ধ চলমান রাখতে রাশিয়া গত ১৮ মাস ধরে উত্তর কোরিয়া থেকে প্রায় ৬ মিলিয়ন মিউনিশন বা আর্টিলারি শেল আমদানি করেছে। যা মাত্র ৬৪টি সামুদ্রিক পথে চালানের মাধ্যমে রাশিয়ায় পৌঁছে গেছে।
উত্তর কোরিয়ার তৈরি ১৫২ মিমি এবং ১২২ মিমি আর্টিলারি শেল সরবরাহ চলমান ইউক্রেনে সামরিক অভিযানে রাশিয়ার আর্টিলারি ইউনিটে বিপুল পরিমাণ আর্টিলারি সেলের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
ডিফেন্স এক্সপ্রেসের দেয়া তথ্যমতে, উত্তর কোরিয়ার সরবরাহ করা আর্টিলারি সেল দ্বারা ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনে রাশিয়ার মোট গোলাবারুদের প্রায় ৪০% পর্যন্ত অবদান রেখেছে।
উত্তর কোরিয়া মূলত গত ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে চলতি ২০২৫ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত এই বিপুল পরিমাণ আর্টিলারি সেলের চালান রাশিয়ায় পাঠিয়েছে। উত্তর কোরিয়ার সরবরাহ করা আর্টিলারি সেল রাশিয়ার সেনাবাহিনীর প্রতিদিন গড়ে ৭,৪০০ অতিরিক্ত রাউন্ড চাহিদা পূরণ করে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার সাথে রাশিয়ার কৌশলগত অংশীদারিত্ব এবং সামরিক সহযোগিতা আরও গভীর হয়েছে। উত্তর কোরিয়া তেল এবং আর্থিক সহায়তার মতো সম্পদের বিনিময়ে প্রয়োজনীয় গোলাবারুদ এখনো পর্যন্ত সরবরাহ করে যাচ্ছে।
বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি: রাশিয়ার এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম!
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত, অত্যাধুনিক এবং ব্যাপক চাহিদাসম্পন্ন এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমগুলোর মধ্যে একটি হলো রাশিয়ার তৈরি অত্যাধুনিক S-400 Triumf এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। এটি হচ্ছে একটি দীর্ঘ পাল্লার surface-to-air missile (SAM) প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা শত্রু পক্ষের যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার, ড্রোন, ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল আকাশেই ইন্টারসেপ্ট বা প্রতিহত করতে সক্ষম।
এই শক্তিশালী এবং ডেডিকেটেড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমটি বর্তমানে রাশিয়া, চীন, ভারত, তুরস্ক, বেলারুশ এবং আলজেরিয়ার মতো দেশের সামরিক বাহিনীর হাতে সক্রিয়ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়াও সৌদি আরব, কাতার, ইরান ও ইরাকের মতো দেশগুলো এই সিস্টেম কেনার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে এর মূল ব্যবহারকারী দেশ হচ্ছে রাশিয়া নিজেই।
গত ২০২৪ সালের হিসেব অনুযায়ী রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর কাছে বর্তমানে প্রায় ৫৬ থেকে ৬০টির মতো S-400 Triumf ব্যাটালিয়ন রয়েছে। এই জাতীয় একটি পূর্ণাঙ্গ ডিফেন্স সিস্টেম ব্যাটালিয়নে সাধারণত ৮টি ফায়ারিং ইউনিট (TELs – Transporter Erector Launchers) থাকে এবং প্রতিটি ইউনিটে ৪টি করে মিসাইল টিউব থাকে—এভাবে একটি ব্যাটালিয়নে প্রায় ৩২টি মিসাইল তাৎক্ষণিকভাবে লঞ্চের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়।
গত ২০১৪ সালে চীন S-400 কেনার জন্য রাশিয়ার সাথে প্রথম আন্তর্জাতিক চুক্তি করে এবং প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ৬টি ব্যাটালিয়ন সংগ্রহ করে। বর্তমানে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির হাতে প্রায় ২ থেকে ৩টি রেজিমেন্ট বা প্রায় ৬ থেকে ৮টি ব্যাটালিয়ন এস-৪০০ ডিফেন্স সিস্টেম ইউনিট রয়েছে বলে বিভিন্ন উন্মুক্ত সামরিক বিশ্লেষণ ও রুশ প্রতিরক্ষা সংস্থার সূত্র থেকে জানা যায়।
তাছাড়া সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, চীন কেবল প্রতিরক্ষার জন্য নয়, বরং এই প্রযুক্তির উপর গবেষণা ও ভবিষ্যতে নিজস্ব উন্নত সংস্করণ তৈরির লক্ষ্যে এটি সংগ্রহ করেছিল। পরবর্তীতে চীন তার নিজস্ব প্রযুক্তির HQ-9B ও HQ-22 নামে লং রেঞ্জ মিসাইল সিস্টেম তৈরি করে, যা অনেকাংশে S-400 এর অনুরূপ বলে দাবি করা হয়।
চীনের পর গত ২০১৮ সালে ভারত রাশিয়ার সঙ্গে প্রায় ৫.৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে ৬টি রেজিমেন্ট S-400 সিস্টেম ক্রয়ের চূড়ান্ত চুক্তি করে। যা গত ২০২১ সাল থেকে ভারত পর্যায়ক্রমে এসব ইউনিট গ্রহণ করে এবং চীন ও পাকিস্তান সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় মোতায়েন করে। ভারতের এই সিদ্ধান্ত প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করে।
অন্যদিকে, ন্যাটো সদস্য তুরস্ক ২০১৭ সালে রাশিয়ার সঙ্গে ২.৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তিনটি S-400 ইউনিটের চুক্তি করে এবং গত ২০১৯ সালে প্রথম চালান গ্রহণ করে। এই সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক খারাপ হয় এবং আমেরিকা তুরস্ককে F-35 স্টেলথ ফাইটার প্রোগ্রাম থেকে বের করে দেয়। যদিও পরবর্তীতে তুরস্ক এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয়ের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেনি।
রাশিয়ার নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি এস-৪০০ এয়ার টু সারফেস ডিফেন্স সিস্টেমকে বর্তমানে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং অত্যাধুনিক ডিফেন্স সিস্টেম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর সিস্টেমের চারটি ক্যাটাগরির ইন্টারসেপ্টর মিসাইল ব্যবহার করা হলেও এর 40N6 interceptor মিসাইল প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৪.৮ কিলোমিটার বেগে সর্বোচ্চ ৪০০ কিলোমিটার দূরত্বে এরিয়াল টার্গেট ধ্বংস করতে সক্ষম।
এর রাডার সিস্টেম একই সঙ্গে ৩০টির বেশি লক্ষ্যবস্তু ট্র্যাক করতে পারে এবং ৪০টিরও বেশি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। রাশিয়ার দাবি অনুযায়ী, এর শক্তিশালী রাডার মার্কিন F-22 Raptor এবং F-35 Lightning II এর মতো স্টেলথ যুদ্ধবিমান শনাক্ত করতে সক্ষম। এটি বিশ্বের অন্যতম সেরা বিমান প্রতিরক্ষা সিস্টেম হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই পরিচিত হয়ে আসছে।
তবে ২০২৩ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে ক্রিমিয়াতে স্থাপনকৃত কয়েকটি রাশিয়ান S-400 ইউনিট, যুক্তরাজ্য সরবরাহকৃত Storm Shadow ক্রুজ মিসাইল দ্বারা ধ্বংস হয়ে যায় বলে তথ্য প্রকাশ পায়। যা নিয়ে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে এবং নিবিড়ভাবে স্টাডি করে যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয় যে তারা আর এই ডিফেন্স সিস্টেমকে তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষার জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে না।
এদিকে অতি সম্প্রতি পাকিস্তান দাবি করে যে, তাদের বিমান বাহিনী নাকি ভারতের একটি S-400 ইউনিট ধ্বংস বা মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছ। কিন্তু এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কোনো নিরপেক্ষ উৎস থেকে এর সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে যাই হোক না কেন, এখন এই ডিফেন্স সিস্টেম শুধু একটি প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি নয়, বরং এটি বিশ্ব রাজনীতির শক্তির ভারসাম্য এবং আধিপত্য বিস্তারের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
পরিশেষে বলা যায় যে, একবিংশ শতাব্দীর লেজার, কমব্যাট ড্রোন এবং হাইপারসনিক মিসাইল টেকনোলজির যুগে নিদির্ষ্ট কোনো এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমই আসলে একটি দেশের আকাশ ব্যবস্থার পুরোপুরি নিরাপত্তা দিতে পারে না। বিশেষ করে নাগার্নো-কারাবাখ, সিরিয়া এবং ইউক্রেন যুদ্ধে তা প্রমাণিত হয়ে গেছে। এজন্য একটি দেশের সুরক্ষিত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে লেয়ারভিত্তিক ইন্টিগ্রেটেড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক পরিচিতি:-
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman),
শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ।
sherazbd@gmail.com