এপ্রিল ১৯, ২০২৫
লেডিঞ্জে গ্রেন্ড, স্টকহোম,সুইডেন
বাংলাদেশ

মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর রামগতি থানা মুজিব বাহিনী’র সংক্ষিপ্ত পরিসরে স্মৃতি চারণ

পাকিস্তানিদের দ্বারা বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র, জাতিগত, শ্রেণিগত বৈষম্য ও অর্থনৈতিক শোষণ-নিষ্পেষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬’র ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০’র নির্বাচন, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ১৯৭১’র ২ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ এবং ৭ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে জাতিকে মুক্তি ও স্বাধীনতার সকল দিক নির্দেশনা দিয়ে আমাদের প্রস্তুত থাকার আহবান ও স্বাধীন বাংলা ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ২৩ মার্চ ১৯৭১-এ ক্যান্টনমেন্ট ও গভর্নর হাউজ (বর্তমান বঙ্গভবন) ব্যতীত সমগ্র বাংলাদেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকি।

১৯৭০’র নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেলেও সরকার গঠনে ও ক্ষমতা হস্তান্তরে ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার টালবাহানা করে এবং ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাতের অন্ধকারে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে নিরস্ত্র নিরীহ মুক্তিকামী বাঙালির উপর অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা চালায়, যা পরবর্তী ৯ মাস ব্যাপী হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালাতে থাকে। আতঙ্কিত ও জীবনের ভয়ে প্রায় ১ কোটি বাঙালি ভারতে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং প্রায় ২/৩ কোটি অভ্যন্তরীণ শরণার্থী হয়ে পালিয়ে জীবন রক্ষা করে।

২৬ মার্চ ১৯৭১’র প্রথম প্রহরে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশকে পাকিস্তানি হানাদার দখলমুক্তের লড়াই ‘মুক্তিযুদ্ধ’।

১০ এপ্রিল ১৯৭১ বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করে ১৭ এপ্রিল কুস্টিয়ার বৈদ্যনাথ তলায় বাংলাদেশের জনগণের জন্য ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার’ প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়।

শুরু হয় ছাত্র-জনতা-বাঙালি সৈনিকদের সংগঠিত-ভাবে মুক্তিবাহিনী গঠন, তৎকালীন ভারত সরকারের সহযোগিতায় সামরিক প্রশিক্ষণ এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী থেকে দেশকে দখলমুক্ত করার ৯ মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী গেরিলা যুদ্ধ।

মুজিব বাহিনীর ইস্টার্ন সেক্টরে ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য ট্রানজিট ক্যাম্প ও দেশের অভ্যন্তরের ছাত্র-যুবাদের যোগাযোগ করে এনে রিক্রুট, দল ঠিক করে কোথায় প্রশিক্ষণ, প্রশিক্ষণের পর যোদ্ধাদের দলের দায়িত্ব বণ্টন ও দল ঠিকের পর অস্ত্র সজ্জিত করে এবং দেশের অভ্যন্তরে নিরাপদে প্রবেশের সকল গুরু দায়িত্বগুলো পালন করেন আ স ম আবদুর রব।

আমাকে বাংলাদেশের সকল অঞ্চলের আরও অনেকের সাথে ভারতের দেরাদুন ডিসট্রিক্টের চাকরাতা ক্যান্টনমেন্ট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ৬ সপ্তাহ সামরিক প্রশিক্ষণ ও গেরিলা যুদ্ধের কৌশল প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এবং মুজিব বাহিনীর বৃহত্তর রামগতি থানার ডেপুটি কমান্ডারের দায়িত্ব প্রাপ্ত হই।

রামগতিতে আমাদের বাহিনী দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতে জীবন উৎসর্গে ইচ্ছুক সাহসীদের নিয়ে অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ দিয়ে যোদ্ধা ও দলের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকি এবং অন্যান্য সহযোদ্ধাদের সহিত পরিকল্পনা করে ধাপে ধাপে গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ করে পাকিস্তানি হানাদার ও দোসরদের উপর আক্রমণ চালাতে থাকি।

অবশেষে ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ রামগতি শত্রু দখলমুক্ত হয়। বিজয়ের সংবাদে উৎফুল্ল জনতা রামগতির প্রতিটি বাজারের সকল দোকানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। বৃহত্তর রামগতির শিশু-কিশোর, আবাল-বৃদ্ধ জনতা বিজয় উল্লাসে জয় বাংলা, জয় বাংলা ধ্বনির সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে আমাদেরকে আনন্দাশ্রু জড়িত আলিঙ্গনে বীরের স্বাগত জানায়, আমরাও মুক্ত জনগণের সে বিজয় উল্লাসে শরীক হই।

মুজিব বাহিনীর গঠন ছিল নিম্নরূপ:

ইস্টার্ন সেক্টর কমান্ডার: শহীদ শেখ ফজলুল হক মনি।

নোয়াখালী জেলা কমান্ডার: মাহমুদুর রহমান বেলায়েত।

রামগতি হাতিয়া জোনাল কমান্ডার: মোশারফ হোসেন।

জোনাল ডেপুটি কমান্ডার: শাহ্ আবদুল মাজেদ।

রামগতি থানা কমান্ডার: হাসান মাহমুদ ফেরদৌস। (প্রয়াত)

ডেপুটি কমান্ডার: মোঃ মশিউল আলম (হান্নান)।

যুদ্ধের ভৌগলিক কৌশলগত সুবিধার জন্য পরবর্তিতে মোঃ আবু তাহের’কে কমান্ডার ও মোস্তাফিজুর রহমান (শহীদ)’কে ডেপুটি কমান্ডার করে রামগতির উত্তরাঞ্চলীয় কমান্ড গঠন করা হয়। মোস্তাফিজুর রহমানের শাহদাতের পর মোস্তাক আহমেদ ডেপুটি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।

সহযোদ্ধাদের নিয়ে উল্লেখযোগ্য গেরিলা অভিযান: আলেকজান্ডার ও রামদয়াল রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ, রামগতি পুলিশ স্টেশন ও পাকিস্তানি সেনা-ক্যাম্প আক্রমণ, জমিদার হাট রাজাকারদের অ্যামবুশ, রামগতিতে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে পুনঃ আক্রমণে রাতের আধারে নদীপথে বর্বর সেনারা গানবোটের সহযোগিতায় নৌপথে পলায়ন করে এবং সর্বশেষ হাজির হাট রাজাকার ক্যাম্প ঘেরাও ও আত্মসমর্পণে বাধ্য করা।

সব ক’টি যুদ্ধই উল্লেখযোগ্য, তার মাঝে স্মরণীয় হলো জমিদার হাটের যুদ্ধ।

১২ নভেম্বর ১৯৭০ উপকূলীয় অঞ্চল ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বিধ্বস্ত হয়, যাতে পাঁচ লক্ষাধিক উপকূলবাসী প্রাণ হারায়। দুর্গত অঞ্চলের জনগণের জন্য খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণকে ত্রাণের জন্য দেয়া হয় ও মজুত রাখা হয়। চর সীতা ইউনিয়নের কার্যালয় ও ত্রাণের চাল-গম ইত্যাদির মজুত ছিল জমিদার হাট বাজারে। তারই অদূরে কলাকোপা মাদ্রাসায় (পাকা বিল্ডিং) ছিল রাজাকার ক্যাম্প (জনতা সে ক্যাম্পকে ক্যান্টনমেন্ট নামে ডাকতো)।

রাজাকাররা জনগণের সে খাদ্য সামগ্রী তাদের দেয়ার জন্য চেয়ারম্যানকে চাপ দেয়, চেয়ারম্যান তাতে অস্বীকৃতি জানায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে রাজাকাররা হুমকির সহিত দিন-তারিখ-সময় নির্ধারণ করে গম-চাল নেয়ার জন্য আসবে বলে চেয়ারম্যানকে খাদ্য-মজুত গুদামে উপস্থিত থাকতে বলে।

এমতাবস্থায় দিশেহারা ভীতসন্ত্রস্ত চেয়ারম্যান আমাদের কাছে খবর পাঠায়।

আমাদের বাহিনী সময়মত রাজাকার ক্যাম্প ও খাদ্য-গুদামের পথিমধ্যে রাস্তার এল সেইফের মোড়ে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে রাত থেকে ওত পেতে থাকে। দিনের ১২ টার দিকে তারা যখন তাদের অজান্তে রামগতির রাজাকারদের অন্যতম শিরোমণি শামছুল আলম ওরফে মুরগা উকিলের নেতৃত্বে একদল সশস্ত্র রাজাকার নিয়ে আমাদের পাতা ফাঁদের ভিতরে প্রবেশ করে, তখন তারা কিছু বুঝে উঠার আগেই সামনে ও পিছনে দু’দিক থেকেই আক্রমণ করা হয়। সে আক্রমণে রামগতির রাজাকারদের অন্যতম শিরোমণি শামছুল আলম ওরফে মুরগা উকিল সহ ক’জন প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হলেও শত্রু বাহিনী সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ন করে তাদের অস্ত্রগুলো দখল করে জয় বাংলা ধ্বনির সহিত আমাদের বাহিনী আস্তানায় ফিরে আসে। সে যুদ্ধে আমাদের একজন সহযোদ্ধা সোলায়মান গাজী আহত হন। তখন থেকে আজও ঐ স্থান ‘কেচকা মাইরের মোড়’ নামে খ্যাত।

সবক’টি যুদ্ধই দেশমাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গ করা বাহিনীর অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ বীরত্বের সহিত লড়াই করেছেন জোনাল কমান্ডার মোশারফ হোসেন ও থানা কমান্ডার হাসান মাহমুদ ফেরদৌস ও উত্তরাঞ্চলীয় কমান্ডার মোঃ আবু তাহের ভাইয়ের নেতৃত্বে।

সর্বশেষ যুদ্ধ হাজীর হাট :

পরাজয় নিশ্চিত জেনে অন্যান্ন রাজাকার ক্যাম্পের কিছু দুর্ধর্ষ রাজাকার হাজীর হাটের ক্যাম্পের রাজাকারদের সাথে জড়ো হয়। জোনাল কমান্ডার মোশারেফ হোসেন ও উত্তরাঞ্চলীয় কমান্ডার মোঃ আবু তাহেরের নেতৃত্বে সে ক্যাম্প অবরোধ করে তাদেরকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করে তাদের অস্ত্রগুলো দখলে আনার মাধ্যমে রামগতি সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়।

রামগতির দু’জন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান ও আলী আহমদ সহ সকল সহযোদ্ধাদের বীরত্ব শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ ও রক্তিম অভিবাদন।

সংক্ষিপ্ত পরিসরে স্মৃতিচারণের জন্য সহযোদ্ধাদের নাম উল্লেখ করিতে পারি নাই বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত ও ক্ষমা-সুন্দরভাবে দেখার বিনীত অনুরোধ রাখলাম।

১৯৭১ এর ৯ মাসে পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আলবদর গং বাংলাদেশে ৩০ লক্ষ নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করে, বর্বরোচিত নির্যাতনের মাধ্যমে ৩-৪ লক্ষ মা-বোনকে ধর্ষণ করে, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়, অর্থ-সম্পদ লুট করে।

৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে ভারতীয় সেনা ও মুক্তি বাহিনীর যোগে যৌথ বাহিনী গঠন করে। যৌথ বাহিনীর নৌ-বিমান-পদাতিক বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী দিশেহারা হয়ে পরে।

এবং পরাজয় নিশ্চিত জেনে ডিসেম্বরের ১০-১৪ তারিখের মধ্যে বাংলাদেশকে মেধা-শূন্য করার জন্য তালিকা করে ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষক, সাহিত্যিক-লেখক ও অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদেরকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে নির্মম ভাবে নির্যাতনের পর হত্যা করে রায়ের বাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে ফেলে রাখে।

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার সামরিক বাহিনী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যৌথবাহিনীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় যুদ্ধ এবং বাংলাদেশ হয় পাকিস্তানি হানাদার দখলমুক্ত। চূড়ান্ত বিজয়ের সংবাদে আমরা জয় বাংলা ধ্বনির সহিত আকাশের দিকে গুলি ছুড়ে জনগণের সাথে বিজয় আনন্দে উল্লসিত হই।

৮ জানুয়ারি ১৯৭২ পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তির পর ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ ঢাকা স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিক ভাবে মুজিব বাহিনী বাংলাদেশ সরকার প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে আমাদের অস্ত্র জমা দিয়ে আমরা যার যার কাজে ফিরে যাই।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় হোক মেহনতি মানুষের।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, মোঃ মশিউল আলম(হান্নান)

মুজিব বাহিনী ডেপুটি কমান্ডার

বৃহত্তর রামগতি থানা, লক্ষ্মীপুর।

    Leave feedback about this

    • Quality
    • Price
    • Service

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field
    Choose Image
    Choose Video