জানুয়ারি ২৩, ২০২৫
লেডিঞ্জে গ্রেন্ড, স্টকহোম,সুইডেন
মতামত

বাংলাদেশে সামাজিক মাধ্যমে যে রাজনৈতিক ঘৃণার চাষ হচ্ছে, এর ফল কী হবে?

আজিজুর রহমান আসাদ : বাংলাদেশে সামাজিক মাধ্যমে যে রাজনৈতিক ঘৃণার চাষ হচ্ছে, এর ফল কী হবে? ঘৃণা একটি শক্তিশালী, তীব্র ও নেতিবাচক মানসিক প্রতিক্রিয়া যা অপছন্দ বা ক্রোধ থেকেও বেশি কিছু। রাজনৈতিক ঘৃণা থেকে আসে ‘ফাইনাল সল্যুশন’, বা হত্যার বৈধতা যা ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য। এই অবস্থায় মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণ শুনতে বা বুঝতে চায় না। এটি সময়ের সাথে বাড়তে থাকলে, তা ব্যাপক সহিংসতার শর্ত তৈরি করে। যা দেখা গেছে জার্মানিতে ইহুদী ও বামপন্থী নিধনে, উপমহাদেশে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়, ইন্দোনেশিয়ায় সাম্যবাদী নিধনে, প্যালেস্টাইনে নারী ও শিশু হত্যায়, এবং দুনিয়ার নানা প্রান্তে চলমান যুদ্ধে।

অনেক প্রবাসী বাংলাদেশী, নিজে নিরাপদ অবস্থানে থেকে সামাজিক মাধ্যমে নিরন্তর ঘৃণার প্রচার করে যাচ্ছেন। এরা বাংলাদেশে রক্তাক্ত সহিংসতা উস্কে দেয়ার কাজে নিয়োজিত, নিজেদের অজান্তেই। ঘৃণার অনেকগুলো মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে।
(১) ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি। নিজেদের পরিচয়, মূল্যবোধ, সম্পদ ও জীবন হুমকির মুখোমুখি হলে, এরা কারণ খোঁজে, এবং প্রায়শই সমস্যার কারণ হিসেবে কোন ব্যক্তি বা গ্রুপকে চিহ্নিত করে। তা হতে পারে, জাতীয়, ধর্মীয়, দলীয় পরিচয় রাজনীতির প্রোপাগান্ডার ফলে সৃষ্ট ধারনা।

(২) বি-মানবিকায়ন। কোন ব্যক্তি বা দলকে ‘দানব’, ‘খুনি’, ‘হত্যার যোগ্য’ হিসেবে ভাষা ব্যবহার যাতে আগামীতে এদের বিরুদ্ধে সহিংসতার বৈধতা দেয়া যায়। যাদের ঘৃণা করা হয়, তাদেরকে মানবেতর হিসেবে প্রমাণ করার প্রচার চালানো হয়।

(৩) ব্যক্তিগতভাবে মানসিক আঘাত পেলে বা ঈর্ষা থেকেও ঘৃণা জন্মায়। যাদের কাছ থেকে ‘ভালো’ কিছু প্রত্যাশা ছিল, সেই প্রত্যাশা পূরণ না হলে ঘৃণার জন্ম নেয়, সেটা বাড়তে বাড়তে তীব্র ঘৃণার জন্ম নেয়। কিংবা কারো সাফল্য ও ক্ষমতা দেখে এতোটাই ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠে যে তা তীব্র ঘৃণায় পরিণত হয়।

(৪) হতাশা, রাগ ও ক্ষোভ পুষে রাখার ফলে, নিজের হতাশা বিশ্লেষণ না করার ফলে কারো উপর দায় চাপিয়ে তাঁকে ঘৃণিত হিসেবে বিশ্বাস করা শুরু হয়, এবং নানা ধরনের অবিচারের কারণ হিসেবে দায়ী করে ঘৃণার মাত্রা বাড়াতে থাকে।

(৫) ধর্মান্ধতা ও মতান্ধতা। এটি প্রধানত ধর্মীয় ও রাজনৈতিক। যারা ভিন্ন ধর্মের ও ভিন্ন রাজনৈতিক মতের, তাঁদেরকে ‘নির্বোধ’, ‘হেয়’, ‘হীন’, ‘নীতিহীন’, ইত্যাদি ধারনা বিশ্বাস ও প্রচার করে। চূড়ান্তভাবে এদের প্রতি সহিংসতাকে বৈধতা দেয়।

(৬) আত্ম-প্রতিফলন। অর্থাৎ নিজে যা তা অপরকে ভাবা। যাদের অপছন্দ করা হয় বা বিরোধী শক্তিকে অভিধা দেয়া হয়, যেমন খুনি, ফ্যাসিবাদী, অমানুষ ইত্যাদি। এটি আসলে নিজেদের প্রতি ধারনা যা রয়েছে মনের গভীরে, সাব কনসাসনেসে। অপরের আয়নায় নিজের মুখ দেখা।
(৭) সামাজিকায়ন। পরিবারে ও যাদের সাথে বেড়ে ওঠা তাঁদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজের মধ্যে ঘৃণার চাষ অব্যাহত রাখা, এবং একসময় নিরন্তর ঘৃণা প্রচারে নিয়োজিত হওয়া।

(৮) নানা ধরনের বায়াস বা চিন্তার ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব। এমন সব তথ্যের ব্যাপারে আগ্রহ যা নিজের কনফার্মেশন বায়াস এর পক্ষে। একই সাথে রয়েছে বিপরীত তথ্য সম্পর্কে এমোসনাল ডিফেন্স। সেই সব গুজবে বিশ্বাস যা নিজের পূর্বধারনার ও ঘৃণার সাথে সম্পর্কিত।

(৯) অসহায়ত্ব বোধ ও অতীত অভিজ্ঞতার বদহজম। এটি প্রধানত এমন আবেগ যা প্রকাশ করা যায় নি। নিজের অক্ষমতার কারণ হিসেবে অন্য কাউকে দোষী ভাবা হয়েছে এবং মনের ভেতরে ঘৃণার চাষ শুরু হয়েছে। এর ফলে একধরনের প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে ওঠা এবং ঘৃণা প্রচার করা।
(১০) এটি একটি মানসিক বৈকল্য হতে পারে, যার নাম ‘বর্ডার লাইন পার্সনালিটি ডিজঅর্ডার’, যা সহানুভূতি, ক্ষমা, অন্যকে বোঝার চেষ্টা ইত্যাদির বদলে ব্যক্তিতাবাদী আত্মসর্বস্ব নার্সিসিস্ট হয়ে ওঠে। অব্যাহত ঘৃণার প্রচার করে বেড়ায়।

ব্যক্তির আবেগ অনুভূতি মূল্যবান, কিন্তু নেতিবাচক আবেগ অনুভূতির চর্চা, যেমন ঘৃণা চর্চা, শুধু ব্যক্তির মানসিক সুস্থ্যতার সমস্যা নয়, এটি সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনে। ‘সত্য আমাদের মুক্তি দেবে’, এবং ‘সত্য’ আসে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা থেকে, ঘৃণার আবেগ থেকে নয়।
লেখক : গবেষক। ফেসবুক থেকে