মে ১২, ২০২৫
লেডিঞ্জে গ্রেন্ড, স্টকহোম,সুইডেন
অর্থনীতি বাংলাদেশ

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধের প্রভাব

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব কাটতে না কাটতেই এবার ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দারুন প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

করোনা মহামারির পর বিশ্বের মানুষ যখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছে এবং অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, এর মাঝেই শুরু হয়েছে ইউরোপের দুুই দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ; যার প্রভাব পড়েছে সারা বিশ্বে। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবীর এক প্রান্তে কোনো সংকট তৈরি হলে তার প্রভাব পড়ে বিশ্বব্যাপী। এই যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব আবার বড় ধরনের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের নতুন করে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দুইটি দেশে বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের বর্তমান সমসাময়িক যুদ্ধের পরিস্থিতির ঘটনা কি কেন্দ্র করে অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ছোট আয়তনের জনবহুল দেশ হওয়ায় এর প্রায় সব কিছুর জন্যই বাইরের দেশগুলোর ওপর নির্ভর করতে হয়। এর ফলে বাংলাদেশকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য, তেল, গ্যাস, যন্ত্রাংশ ইত্যাদি পণ্য বাইরের দেশগুলো থেকে আমদানি করতে হয়।

বাংলাদেশ অনেক পণ্যই রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি করা হতো, ঠিক তেমনি বিপরীতে বাংলাদেশের ও ভারতের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকা অবস্থায় বাংলাদেশের অনেক পণ্য ভারত থেকে আমদানি রপ্তানি করা হতো, পরবর্তী সময় ৫ই আগস্ট এর পর ভারতের সাথে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে যখন টানা উত্তেজনা চলছিল ঠিক সেই সময়টাতে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের নতুন করে সম্পর্কের গড়ে ওঠে, এমনই পরিস্থিতিতে বর্তমানে ভারত ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের ডামাডলে যুদ্ধের মহড়ায় উভয় দেশের অর্থনীতিতে দারুন প্রভাব পড়েছে সংকট এ বাংলাদেশ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গম, সূর্যমুখী তেল, ভুট্টা, তুলা, সরিষা, মসুর ডাল, জ্বালানি তেল, গ্যাস ইত্যাদি।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারত থেকে আমদানি করেছে ৪৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের পণ্য এবং রাশিয়ায় রপ্তানি করা হয়েছে ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের পণ্য।

বাংলাদেশ মূলত যে পণ্যটি ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি আমদানি করে থাকে তা হলো গম ও চাউল, সূর্যমুখী তেলের বড় অংশই আসে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে। এ ছাড়া বিভিন্ন খাদ্যশস্য; যেমন—ভুট্টা, তুলা, সরিষা ও মসুর ডালের চাহিদাও এই দুটি দেশ থেকে পূরণ করা হয়।

কিন্তু বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে এবং রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে এসব পণ্য আমদানি করা নিয়ে বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে এ দেশের অর্থনীতিতে এবং এর প্রধান ভুক্তভোগী হচ্ছে এ দেশের দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এরই মধ্যে আমরা লক্ষ করলে দেখতে পাই, বাজারে এসব পণ্যের দাম ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর চেয়েও বেশি হারে বেড়েছে। এর ফলে দেশের প্রায় বেশির ভাগ মানুষেরই তাদের সীমিত উপার্জন দিয়ে পরিবার নিয়ে জীবন ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

আমরা লক্ষ করলে দেখতে পাই, গম, ভুট্টা, সরিষা—এই শস্যগুলো পশুখাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। এগুলোর দাম বেড়ে গেলে পশুখাদ্যের দামও বেড়ে যাবে।

এতে দরিদ্র খামারিরা গবাদি পশু পালনে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন।
রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে বাজারে তেলের সরবরাহ কমে যাওয়া। এখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে মূল্যস্ফীতির প্রভাব বাংলাদেশের বাজারেও পড়বে। এর ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে খরচের পরিমাণ আরো অনেক বেড়ে যাবে।

বর্তমানে রাশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহকারী দেশ। রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিলে গ্যাসের দাম কয়েক গুণ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে; যদিও বাংলাদেশের গ্যাস বিতরণ কম্পানিগুলো এরই মধ্যে গ্যাসের দাম প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এটি কার্যকর হলে মানুষের আয়ের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

এ ছাড়া আমরা জানি যে গ্যাস ও তেল বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রয়োজন হয়। যদি গ্যাস ও তেলের দাম বেড়ে যায়, তাহলে বিদ্যুতের দামও বেড়ে যাবে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাবে এবং মানুষের আয় হ্রাস পাবে। বিদ্যুতের দাম বেড়ে গেলে ফসল উৎপাদন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে, যা দেশে বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প। আর তৈরি পোশাক খাতের নতুন বাজার হচ্ছে রাশিয়া। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় প্রায় ৬০ কোটি ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। কিন্তু চলমান সংকট ও বিধি-নিষেধের জন্য পোশাক রপ্তানি নিয়েও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানি পণ্য পরিবহনে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ বর্তমানে যে অর্থনৈতিকন পরিস্থিতিতে রয়েছে, তা থেকে সহজে উত্তরণ সম্ভব নয়। যদি ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ আরো দীর্ঘায়িত হয় এবং আন্তর্জাতিক বিধি-নিষেধ শিথিল করা না হয়, তাহলে বাংলাদেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে পড়ে যাবে।