জুলাই ১৯, ২০২৫
লেডিঞ্জে গ্রেন্ড, স্টকহোম,সুইডেন
বাংলাদেশ

জনগণের টাকায় কেনা অস্ত্র দিয়ে হত্যা : সেনাবাহিনীর দায়িত্ব ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য গঠিত একটি প্রতিষ্ঠান, যার অর্থায়ন আসে জনগণের দেওয়া করের টাকায়। এই অর্থে, সেনাবাহিনীর হাতে থাকা প্রতিটি অস্ত্র জনগণের সম্পদ, যা জাতীয় নিরাপত্তা ও জনগণের সুরক্ষার জন্য ব্যবহার হওয়ার কথা। কিন্তু সম্প্রতি গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনীর গুলিতে কয়েকজন নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনা এই প্রশ্ন তুলেছে: জনগণের টাকায় কেনা অস্ত্র কি জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায়?

সেনাবাহিনীর অস্ত্র: জনগণের সম্পদ

বাংলাদেশের সেনাবাহিনী জনগণের করের টাকায় পরিচালিত হয়। প্রতিরক্ষা বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে অস্ত্র ক্রয়, প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এই অর্থ জনগণের কষ্টার্জিত সম্পদ, যা দেশের নিরাপত্তা ও জনগণের কল্যাণের জন্য ব্যবহারের প্রত্যাশা করা হয়। সংবিধানের ৮৭ ও ৮৮ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে সরকারি তহবিল জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে। তাই সেনাবাহিনীর হাতে থাকা অস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা শুধু সংবিধানের লঙ্ঘনই নয়, জনগণের প্রতি তাদের নৈতিক দায়বদ্ধতারও লঙ্ঘন।

বাংলাদেশের আইন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার

বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদে নাগরিকদের জীবন ও স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। দণ্ডবিধি (১৮৯৮) অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সেনাবাহিনী প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে শুধুমাত্র তখনই যখন এটি জীবনের জন্য গুরুতর হুমকির প্রেক্ষিতে একেবারে অপরিহার্য। গোপালগঞ্জের ঘটনায় সেনাবাহিনী দাবি করেছে যে তারা আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছে, কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ, এই বলপ্রয়োগ অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয় ছিল। এই ধরনের ঘটনা সংবিধানের লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত, কারণ জনগণের বিরুদ্ধে তাদের নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার করা জনগণের প্রতি বিশ্বাস ঘাতকতার শামিল।

আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, যেমন জাতিসংঘের ‘Basic Principles on the Use of Force and Firearms’ (১৯৯০), স্পষ্টভাবে বলে যে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার শেষ অবলম্বন হিসেবে এবং শুধুমাত্র জীবনের জন্য গুরুতর হুমকির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি (ICCPR, Article 6) মানুষের জীবনের অধিকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। গোপালগঞ্জের ঘটনায়, প্রমাণিত হয় যে বলপ্রয়োগ অতিরিক্ত বা নির্বিচারে ছিল, এটি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।

নৈতিক দায়বদ্ধতা

সেনাবাহিনী জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করবে, তাদের বিরুদ্ধে নয়। জনগণের টাকায় কেনা অস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা শুধু আইনগতভাবেই অন্যায় নয়, এটি নৈতিকভাবেও অগ্রহণযোগ্য। সেনাবাহিনীর প্রাথমিক দায়িত্ব হলো জনগণের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করা। গোপালগঞ্জের ঘটনায়, একজন অটোরিকশাচালকের মতো নিরীহ ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা জনগণের মধ্যে ভয় ও অবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে। এটি সেনাবাহিনীর সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের ক্ষতি করেছে এবং তাদের প্রতি জনগণের আস্থা কমিয়েছে।

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা

গোপালগঞ্জের ঘটনার মতো ঘটনায় স্বচ্ছ তদন্ত অত্যন্ত জরুরি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এই ঘটনার স্বাধীন তদন্তের দাবি জানিয়েছে। জনগণের টাকায় কেনা অস্ত্রের অপব্যবহার রোধে সেনাবাহিনীকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। তদন্তের মাধ্যমে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে বলপ্রয়োগ সমানুপাতিক এবং প্রয়োজনীয় ছিল কিনা। এছাড়া, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণে মানবাধিকার ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার উপর জোর দেওয়া উচিত।

পরিশেষে এটা বলতেই হবে যে, জনগণের টাকায় কেনা অস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা কোনোভাবেই ন্যায়সঙ্গত নয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচিত জনগণের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষায় তাদের দায়িত্ব পালন করা, তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহার নয়। গোপালগঞ্জের ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে সেনাবাহিনীর ক্ষমতার সঙ্গে আসে বিশাল দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা অপরিহার্য। জনগণের আস্থা অর্জন ও ধরে রাখতে হলে সেনাবাহিনীকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে তাদের অস্ত্র জনগণের সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়, তাদের প্রাণ নেওয়ার জন্য নয়।