নামিদ মাহমুদ : শেখ হাসিনা সরকার ১ আগস্ট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঘোষণা করেছিল যে ২০০৯ এর ধারা ১৮(১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, “যেহেতু, সরকারের নিকট যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ রহিয়াছে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং উহার অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সাম্প্রতিককালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল। সরকার বিশ্বাস করে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সকল অঙ্গ সংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সহিত জড়িত রহিয়াছে।
আজ ঠিক একই আইনের ধারায়, বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করল অন্তবর্তীকালিন সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে তারা বলছেন, ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হত্যা, নির্যাতন, গণরুম কেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজী, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ নানাবিধ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকান্ডে জড়িত ছিল এবং এ সম্পর্কে প্রামান্য তথ্য দেশের সব প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এবং কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হয়েছে।
আমি জানি না, ব্যক্তির অপরাধ সংগঠনগুলোর অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় কি না। ব্যক্তি বা সত্তা আইনে বলা হচ্ছে, আর নিষিদ্ধ হচ্ছে রাজনৈতিক অংগ সংগঠন। ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ (১) ধারায় বলা হয়েছে, “এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, সরকার, কোনো ব্যক্তি বা সত্তা সন্ত্রাসী কার্যের সহিত জড়িত রহিয়াছে মর্মে যুক্তিসঙ্গত কারণের ভিত্তিতে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, উক্ত ব্যক্তিকে তফসিলে তালিকাভুক্ত করিতে পারিবে বা সত্তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা ও তফসিলে তালিকাভুক্ত করিতে পারিবে।
এই আইন যদি সত্যি প্রয়োগ করা হয়, পত্রিকার খবরগুলোকে বেইজড ধরা হয়, তাহলে এই আইনের বলে আরো কিছু ছাত্র সংগঠন, যুব সংগঠন নিষিদ্ধ হবে। কারণ, ওই আইনের সন্ত্রাসী কাজের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি, সত্তা বা বিদেশী নাগরিক বাংলাদেশের অখণ্ডতা, সংহতি, জননিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার জন্য জনসাধারণ বা জনসাধারণের কোনো অংশের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার বা কোন সত্তা বা কোনো ব্যক্তিকে কোনো কাজ করতে বা করা থেকে বিরত রাখতে বাধ্য করার জন্য অন্য কোনো ব্যক্তিকে হত্যা, গুরুতর আঘাত, আটক বা অপহরণ করে বা করার চেষ্টা করে, এ ধরনের কাজের জন্য অন্য কারো সঙ্গে ষড়যন্ত্র বা সহায়তা বা প্ররোচিত করে; অথবা অন্য কোনো ব্যক্তি, সত্তা বা প্রজাতন্ত্রের কোনো সম্পত্তির ক্ষতি করে বা করার চেষ্টা করে; অথবা ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র বা সহায়তা বা প্ররোচিত করে; অথবা এ ধরনের উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য, দাহ্য পদার্থ ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে বা নিজ দখলে রাখে, কোনো সশস্ত্র সংঘাতময় দ্বন্দ্বের বৈরি পরিস্থিতিতে অংশ নেয়, তাহলে তা ‘সন্ত্রাসী কাজ’ বলে গণ্য হবে।
ছাত্র সংগঠনগুলো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কিন্তু গোষ্ঠিকেন্দ্রিক হয়েছে আবার অনেক সময় ব্যক্তি কেন্দ্রিক। এখন যেখানে সন্ত্রাসীর সংগা দিচ্ছে, সেই শব্দের সুরতানে অনেক কিছুই নিষিদ্ধ করা সম্ভব।
আপনি যদি খোলা চোখে পত্র-পত্রিকাগুলো দেখেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একই ধরনের কর্মকাণ্ড এক সময় ছাত্রদল করেছে, শিবির করেছে। যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে তাদের ভ্রাতৃপ্রতীম ছাত্র সংগঠনগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখল করেছে। সেই ধারাবাহিককতায় গত পনের বছর ক্ষমতায় থাকাকালিন ছাত্রলীগও করেছে।
এখন আপনি কি পারবেন, ওইসব সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করতে? আপনি কি পারবেন, রগ কেটে পঙ্গত্ব বানানো ওইসব ছাত্র সংগঠনগুলোকে ছাত্র রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে?
আওয়ামীলীগের আগে ছাত্রলীগের জন্ম। এইদেশে বায়ান্নো, ছিয়াত্তর, উনোত্তর, একাত্তর, নব্বইয়ে ছাত্রলীগের মুভমেন্ট ও আত্মত্যাগকে অস্বীকারের কোন সুযোগ নেই। তবে অন্যন্য ছাত্র সংগঠনগুলোর মতই ক্ষমতাশীনরা এই ছাত্র সংগঠনগুলোকে ক্ষমতার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে, এইসব সংগঠনের ম্যারপ্যাচে পড়ে পড়াশুনা শেষ করতে পারেনি। অনেকেই আধিপত্য ও প্রতিহিংসার রাজনীতিতে জড়িয়ে পঙ্গত্ব বরণ করেছে, এর দায় ক্ষমতাশীন রাজনৈতিক দলগুলোরই।
আজ ছাত্রলীগ যে অপরাধ করেছে, আগামীকাল বিএনপি এলে একই কর্মে ছাত্রদল জড়িয়ে পড়বে, জামায়াত এলে শিবির দখল করবে। আপনি কি পারবেন তখন তাদেরকে নিষিদ্ধের কাতারে ফেলতে?
‘কোন সংগঠনকে নিষিদ্ধ’ করা মানে হলো আর একটি প্রতিযোগী সংগঠনকে ক্ষমতায়ন করা।
ছাত্রসংগঠনকে নিষিদ্ধ করে সমাধান মিলবে না। আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সবধরনের ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। দেশের ৯০ শতাংশ মানুষই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোন রাজনীতি চাচ্ছে না, কিন্তু আপনারা সেদিকে নজর দিয়েছেন? তাদের কথা শুনছেন?
কিন্তু সেটা না করে বলপ্রয়োগ করে কোন সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে, কেবল স্বেচ্ছাচারিতার চর্চায় হবে। এইসব নিষিদ্ধকেন্দ্রিক ঘোষণা সমাজে আরো বেশি অস্থিরতা তৈরি করবে। জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ হয়েছিল, এরপর আপনারা এসে বললেন, উনাদের বিরুদ্ধে কোন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আজ ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হচ্ছে, আগামীতে তারা ক্ষমতায় কখনো গেলে, তারাও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডগুলো না থাকার কথা বলে নিষিদ্ধতা প্রত্যাহার করবে।
এই ধারা বড়ই নোংরামি। এটা বন্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে কমিটমেন্টে আনতে হবে যে, তাদের কোন ছাত্র সংগঠন থাকবে না। ছাত্র সংসদের মাধ্যমে আগামীর নেতৃত্ব তৈরি হবে। সেটা না করতে পারলে এইদেশ কখনোই শান্তির কাতারে দাঁড়াবে না। চারিদিকে কেবলই অস্থিরতা কাজ করবে। ফেসবুক থেকে