সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকা চীনের বাণিজ্যিক জাহাজ খাতের উপর কঠোর শুল্ক আরোপ করেছে। এর উদ্দেশ্য হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চীনের একচেটিয়া প্রভাব ও অবস্থান খর্ব করা। তবে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ২০২৫ সালের অক্টোবর থেকে নতুন এই শুল্কনীতি বৈশ্বিক সমুদ্রপথ পরিবহণ ব্যয়কে মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে তুলতে পারে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বৈশ্বিক পণ্য আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ওপর।
আমেরিকার এই নতুন শুল্ক নীতিমালায়, চীনা জাহাজের মাধ্যমে আমদানি করা প্রতিটন পণ্যের জন্য চলতি ২০২৫ সাল থেকে ৫০ ডলার শুল্ক ধার্য হয়েছে, যা প্রতি বছর ৩০ ডলার করে বাড়িয়ে পর্যায়ক্রমে আগামী ২০২৮ সালের মধ্যে ১৪০ ডলারে উন্নীত করা হবে। এমনকি অন্য দেশের কোম্পানিগুলিও যদি চীনা জাহাজ ব্যবহার করে মার্কিন বন্দরে পণ্য আনে, সেক্ষেত্রেও অতিরিক্ত ১৮ ডলার শুল্ক গুনতে হবে। Ro-Ro জাহাজে প্রতিটি গাড়ির জন্যও নতুন করে ১৫০ ডলার শুল্ক নির্ধারিত হয়েছে।
বিশ্বে বর্তমানে চীনের হাতে রয়েছে প্রায় ১৫% থেকে ২০% সমুদ্রপথ বাণিজ্য পরিবহণের নিয়ন্ত্রণ। চীনের মার্চেন্ট ফ্লিট প্রায় ১,১৮,৩০০টি জাহাজের সমন্বয়ে গঠিত, যার মধ্যে রয়েছে বিশাল সংখ্যক ট্যাংকার, কন্টেইনারবাহী, বাল্ক ক্যারিয়ার ও কার্গো জাহাজ। শুধু ২০২৪ সালেই দেশটি ১২৩ বিলিয়ন ডলারের জাহাজ নির্মাণ অর্ডার গ্রহণ করেছে। “চায়না মার্চেন্টস শিপিং” কোম্পানিটি একাই ২৮টি নতুন জাহাজের অর্ডার দিয়েছে, যার মূল্য হতে পারে প্রায় ৪.৪ বিলিয়ন ডলার।
গত ২০২৪ সালের হিসেব অনুযায়ী, গ্লোবাল মার্চেন্ট ফ্লিটের ১০% এখন চীনের হাতে, এবং বিশ্বের ৫০% শিপবিল্ডিং ক্যাপাসিটি চীনের নিয়ন্ত্রণে। নতুন জাহাজের প্রায় ৬০% অর্ডারও চীনা নির্মাতাদের কাছে চলে যাচ্ছে। এর অর্থ হলো, বর্তমানে বৈশ্বিক বাণিজ্য অনেকাংশে চীনের শিপিং অবকাঠামোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব গভীর সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজের সংখ্যা মাত্র ১৮০–১৯০টি। গ্লোবাল মার্চেন্ট শিপিংয়ে মার্কিন অংশগ্রহণ ০.৫% এরও নিচে, যা চীনের তুলনায় নিশ্চতভাবেই অনেক পিছিয়ে রয়েছে। যদিও মার্কিন পতাকাবাহী বাণিজ্যিক জাহাজের সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়েছে, তবুও বাস্তবে বৈশ্বিক চাহিদার তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের সামুদ্রিক বাণিজ্যিক সক্ষমতা খুবই সীমিত আকারের বলা চলে।
বর্তমানে ভারতের মার্চেন্ট শিপ ফ্লিটের আকার ১,৫০০টির বেশি (বিশ্ব ফ্লিটের প্রায় ১%-এরও কম), আর রাশিয়ার মার্চেন্ট শিপ ফ্লিটের আকার ২,০০০–২,২০০টি (বিশ্বের প্রায় ১.২%–১.৫%)। এই দুই দেশের শিপিং ফ্লিটের আকার এবং সক্ষমতা যথেষ্ট শক্তিশালী মনে হলেও এক্ষেত্রে ভবিষ্যতে চীনের বিকল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করাটা মোটেও কোন সহজ কাজ হবে না।
বিশ্বের অন্যান্য দেশ যেমন ভারত, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া বা তুরস্কও চীনের বিকল্প হিসেবে ধরা হলেও, তাদের শিপিং ফ্লিট এবং অবকাঠামো এখনো পর্যন্ত চীনের কাছাকাছি পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। তাই এক্ষেত্রে চীনের বিকল্প প্রস্তুত করতে অন্তত এক দশক সময় লাগতে পারে। সেই সাথে এই সেক্টরে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও প্রযুক্তির মতো বিষয়টি সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চীনা বাণিজ্যিক জাহাজের উপর শুল্ক আরোপের ফলে সৃষ্ট অতিরিক্ত খরচের কারণে বহু দেশ হয়তো মার্কিন বন্দর এড়িয়ে চলবে, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরগুলোর আয় হ্রাস পাবে এবং আমদানিকৃত পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। যার নেতিবাচক প্রভাব কিন্তু সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়তে পারে।
উপসংহারে বলা যায়, বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের শিপিং নেটওয়ার্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই কেবল শুল্কারোপ করে চীনের প্রভাব কমানো সম্ভব নয়। বরং এমন পদক্ষেপ বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং মার্কিন স্বার্থের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই বৈশ্বিক অর্থনিতিতে ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজন বাস্তবমুখী, ভারসাম্যপূর্ণ এবং বহুপক্ষীয় সহযোগিতামূলক নীতি অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করা উচিত।
তথ্যসূত্র: ব্লুমবার্গ, রয়েটার্স, বিজিনেস রিসার্চ ইনসাইড।
সংবাদ প্রেরক: সিরাজুর রহমান