জুলাই ১৯, ২০২৫
লেডিঞ্জে গ্রেন্ড, স্টকহোম,সুইডেন
বাংলাদেশ

গোপালগঞ্জে ময়নাতদন্ত ছাড়া দাফন ও সৎকার : আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন

 

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় সেনাবাহিনীর গুলিতে এখন পর্যন্ত পাঁচ জন নিহত হয়েছেন। এই ঘটনায় নিহতদের মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন বা সৎকার করা হয়েছে, যা নিয়ে আইনি ও নৈতিক প্রশ্ন উঠেছে। 

১৬ই জুলাই ২০২৫ তারিখে গোপালগঞ্জে এনসিপির ‘জুলাই পদযাত্রা’ সমাবেশকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের স্থানীয়দের জনসাধারণের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই সংঘর্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে সেনাবাহিনী, নিরীহ জনসাধারণের উপর বলপ্রয়োগ করে সরাসরি গুলি চালায়। এতে ঐদিনই দীপ্ত সাহা (২৫), রমজান কাজী (১৮), সোহেল রানা (৩০), এবং ইমন তালুকদার (২৪) নিহত হন। পরে ঢাকা মেডিকেলে মারা যান আরও একজন, হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, নিহতদের শরীরে গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। এছাড়া, ৯ জন গুলিবিদ্ধসহ শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন।

নিহতদের মরদেহ গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। তবে, পুলিশের এক প্রতিবেদন অনুসারে, উচ্ছৃঙ্খল জনতা ময়নাতদন্ত না করিয়ে মরদেহগুলো জোরপূর্বক হাসপাতাল থেকে নিয়ে যায়। ফলে, কোনো সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি বা ময়নাতদন্ত করা হয়নি। দীপ্ত সাহাকে বুধবার রাতে পৌর শ্মশানে সৎকার করা হয়, রমজান কাজীকে এশার নামাজের পর দাফন করা হয়, এবং সোহেল রানা ও ইমন তালুকদারকে বৃহস্পতিবার সকালে পৌর কবরস্থানে দাফন করা হয়।

বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধি (সিআরপিসি) অনুযায়ী, অপ্রাকৃতিক মৃত্যু, বিশেষ করে গুলি বা সহিংসতায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত বাধ্যতামূলক। সিআরপিসি’র ধারা ১৭৪ এবং ১৭৬ অনুসারে, পুলিশকে অপ্রাকৃতিক মৃত্যুর ঘটনায় সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি এবং ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ময়নাতদন্ত মৃত্যুর কারণ, সময় এবং পরিস্থিতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ সরবরাহ করে, যা ফৌজদারি তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় অপরিহার্য।

গোপালগঞ্জের ঘটনায় ময়নাতদন্ত না করা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, ময়নাতদন্ত না হওয়ায় ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। তারা আরও প্রশ্ন তুলেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার ও গুলির শব্দ স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও পুলিশের দাবি, তারা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেনি। এটি জনমনে বিভ্রান্তি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অনাস্থা বাড়িয়েছে।

নিহতদের পরিবার দাবি করা হয়েছে সেনাবাহিনী নিহতদের দ্রুত দাফনের নির্দেশ দিয়েছে এবং জানাজায় জনসাধারণকে অংশ নিতে বাধা দেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর এমন আচরন এই ঘটনার স্বচ্ছ তদন্তের প্রয়োজনীয়তাকে আরও জোরালো করে।

নিহতদের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তারা ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ হাসপাতালে নিয়ে গেলেও কর্তৃপক্ষ তাদের দ্রুত মরদেহ বাড়িতে নিয়ে যেতে বলেছে। নিহত সোহেল মোল্লার মামা জাহিদুল ইসলাম তালুকদার বলেন, “হাসপাতাল থেকে কোনো ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়নি, ময়নাতদন্তও করা হয়নি।” রমজানের মামা কলিম মুন্সি বলেন, “হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, এখানে সমস্যা হতে পারে, বাসায় নিয়ে যান।” এই বক্তব্যগুলো সরকারি প্রতিবেদনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, যেখানে বলা হয়েছে জনতা জোরপূর্বক মরদেহ নিয়ে গেছে।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সেনাবাহিনী আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়েছিল।  পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবি সমন্বিতভাবে কাজ করেছে। এছাড়া, ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

 

ময়নাতদন্ত না করা শুধু আইনের লঙ্ঘনই নয়, এটি ন্যায়বিচার প্রক্রিয়াকেও বাধাগ্রস্ত করে। ময়নাতদন্তের মাধ্যমে গুলির উৎস, মৃত্যুর কারণ এবং দায়ী পক্ষ চিহ্নিত করা সম্ভব হতো। আসক-এর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই ঘটনা গণতান্ত্রিক অধিকার ও নাগরিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তারা স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন, নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের সুচিকিৎসার দাবি জানিয়েছে।

 

গোপালগঞ্জে ময়নাতদন্ত ছাড়া নিহতদের দাফন আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এটি তদন্ত প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব এবং ন্যায়বিচারের পথে বাধা। ঘটনাটি নিয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। অন্যথায়, জনমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের প্রতি অনাস্থা আরও বাড়বে।