জানুয়ারি ২২, ২০২৫
লেডিঞ্জে গ্রেন্ড, স্টকহোম,সুইডেন
বাংলাদেশ মতামত

ক্রমাগত অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপে ভারত এখন কী কী করতে পারে?

মনজুরুল হক: হেনরি কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলা অনুন্নত সেই দেশটির আরও আগেই উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার কথা থাকলেও সকল সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট, চুরি-ডাকাতির কারণে হয়নি। গত কয়েক বছরে ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রি হওয়ার পথে এগোচ্ছিল। মাত্র তিন মাসেই একজন অর্থনীতিবিদ ‘শান্তির দূতের’ শাসনে বিশ্ব পরিসরে সেই দেশটির পরিচয় এখন ‘এক্সট্রিমিজম, টেরোরিজম এন্ড অর্গানাইজড ক্রাইম’-এর দেশ। এক্সট্রিমিজম-টেরোরিজম আগেও ছিল, তবে খানিকটা চাপা ছিল। এখন যুক্ত হয়েছে অর্গানাইজড ক্রাইম। আরও যুক্ত হয়েছে মুসলিমদের ‘সেক্টরিয়ান ভায়োলেন্স’। এখন এইসব অপবাদ ধামাচাপা দিতে সিলেক্টিভ ক্যামোফ্লেজ তৈরি করা হচ্ছে। দেশ শাসনে সীমাহীন ব্যর্থতা ডাইভার্ট করতে ইসকনকে ‘সন্ত্রাসবাদী সংগঠন’ হিসাবে চিহ্নিত করে নিষিদ্ধ ও দেশদ্রোহীতার দায়ে চিন্ময় কৃষ্ণদাসের ফাঁসি চাওয়া হয়েছে।
🔘
ভক্তিবাদ প্রচার করা এই সংগঠনটির নামে বিশ্বের কোথাও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের রেকর্ড নেই। দেশের এটর্নি জেনারেল ইসকনকে সন্ত্রাসবাদী বললেছেন। আদালতে ইসকন নিষিদ্ধের রিট দাখিল হয়েছে, যদিও আদালত সে দাবী নাকোচ করে দিয়েছে।
যে ‘অপরাধে’ চিন্ময় কৃষ্ণদাসকে গ্রেফতার করে কারাগারে ঢোকানো হয়েছে ওই পাতাকাকাণ্ডে বহুগুণ বেশি অপরাধ করে চলেছে অনেক মুসলিম। তাদের সাত খু-ন মাফ। হেফাজতে ইসলাম প্রকাশ্যে মিছিলে স্লোগান দিয়েছে-‘এক একটা ইসকন ধর/ধইরা ধইরা জবাই কর!’ তার পরও আইন তাদের স্পর্শ করেনি। সারাদেশে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষদের ন্যায্য দাবী দমন করা হয়েছে নির্মমভাবে। বেতনের দাবীতে মিছিল করা গার্মেন্ট শ্রমিককে হত্যা করা হয়েছে। কেউ সামান্যতম আফসোসও করেনি।
🔘
৫ আগস্টের পর শত শত মৃত্যু, অজস্র সরকারি অস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে চলে যাওয়া, দাগী সন্ত্রাসীদের জেল থেকে মুক্ত করা, সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গীদের স্বসম্মানে ছেড়ে দেওয়া, হাজার হাজার আনসার সদস্যকে চাকরিচ্যুত করা, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের জেল-জুলুম-হত্যা, এমনকি আওয়ামী আমলে চাকরি পেয়েছে সেটাকে অপরাধ বলে চাকরিচ্যুত করাসহ সকল প্রকার ‘অর্গানাইজড ক্রাইম’ করা হয়েছে। এমনকি বিচার পছন্দ না হওয়ায় গত বুধবার সুপ্রিম কোর্টের এক বিচারপতিকে ডিম ছুঁড়ে মারা হয়েছে! সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের জোর করে পদত্যাগ করানোর কাহিনী সবার জানা।
🔘
তার পরও বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশকে কেউ ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ বলে বয়কট করেনি, কিন্তু এবার করবে। নিশ্চিত থাকুন; করবে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে না পারায় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আগেই ডোনাল্ড ট্রাম্প সতর্ক করে ট্যুইট করেছেন। আমেরিকার গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড নির্দিষ্ট করে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলেছেন। এবার তাদের সঙ্গে আরও অনেকে যোগ দিয়েছেন, বিশেষ করে ইসকনের ধর্মগুরুকে জেলে ঢোকানো এবং জামিন না দিয়ে কারাগারে ঢোকানোর পরে।
গত ২৫ নভেম্বর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপি ও ফরেন সেক্রেটারি ডেভিড ল্যামির কাছে বাংলাদেশে ইসলামিস্ট এক্সট্রিমিজম ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বিষয়ে সতর্ক করার একটি রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছে। ডেভিড ল্যামি বলেছেন-“বাংলাদেশের দ্রুত অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাজ্যকে আরেকটি বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহে মনোযোগ দিতে হতে পারে।“
🔘
“৫ আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ইসলামপন্থী চরমপন্থীদের ক্ষমতা দখল করাসহ বেশ কয়েকটি উদ্বেগজনক ঘটনাবলির তথ্য দিয়ে বাংলাদেশের নামে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট এমপিদের ক্রস-পার্টি গ্রুপের পররাষ্ট্র সচিবকে জানানো হয়েছে।
কমনওয়েলথের সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপ (এপিপিজি) হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে ২ হাজারেরও বেশি নৃশংসতা রেকর্ড করেছে এবং সতর্ক করেছে যে বর্তমান সরকার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আইনি ব্যবস্থাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশে যে কোনো অস্থিরতা বৃদ্ধির ফলে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে বসবাসরত ৬লাখ ৪৫ হাজার বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অধিবাসীরা সমস্যায় পড়তে পারেন।“ রিপোর্টে বলা হয়েছে-
🔘
“Situation in Bangladesh: Foreign Secretary’s statement” Foreign, Commonwealth & Development Office and The Rt Hon David Lammy MP
5 August 2024
The Foreign Secretary, David Lammy, said:
“The last 2 weeks in Bangladesh have seen unprecedented levels of violence and tragic loss of life. A transitional period has been announced by the Chief of the Army Staff.
All sides now need to work together to end the violence, restore calm, de-escalate the situation and prevent any further loss of life.
The people of Bangladesh deserve a full and independent UN-led investigation into the events of the past few weeks.
The UK wants to see action taken to ensure Bangladesh a peaceful and democratic future. The UK and Bangladesh have deep people-to-people links and shared Commonwealth values.”
🔘
দেশে এখন যে র‌্যাডিক্যাল ইসলামের বাড়বাড়ন্ত তাতে সামনে বাংলাদেশকে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতে পারে। যুক্তরাজ্য, কমনওয়েলথ, ইইউসহ ইউরোপের অনেক দেশে এই ঘটনাবলি গুরুত্বসহ দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ভারতের পাইপ লাইনের গ্যাস, বিদ্যুৎ, নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য, কাপড়, মেশিনারিজ, মশলা, পেঁয়াজ-মরিচসহ বহু ধরণের পণ্যের উপর নির্ভরশীল বাংলাদেশের এখন কমন স্লোগান-“ইসকন নিষিদ্ধ কর, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ নির্মূল কর, ভারতের দালালদের খতম কর, ভারতের দাদাগিরির দাঁতভাঙা জবাব দাও”… এতদিন চলে আসছিল। এবার ধর্মগুরু চিন্ময় কৃষ্ণদাসকে জেলে পুরে ভারতকে পুরোপুরি ‘শত্রু’ কাতারে ঠেলে দেওয়া হলো।
🔘
দেশের সংকট মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে তীব্র ভারতবিরোধীতার জোয়ার বইছে দেশজুড়ে। ভারত কয়েকবার সরকারি পর্যায়ে ইউনূস সরকারের কাছে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলেছে। নিরাপত্তা তো হয়ইনি বরং ইসকনকে ‘র’-এর দালাল বলে তাদের ধর্মগুরুকে জেলে পোরা ভারত ভালোভাবে নেয়নি। ভারতের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল কেন্দ্রকে দ্রুত ‘ব্যবস্থা’ নিতে বলেছে। দিল্লিতে মুসলিমরা ইউনূস সরকারের এ হেন কর্মকাণ্ডের বিরোধীতায় মিছিল সমাবেশ করেছে। ভারতের লোকসভায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গে সেশন হয়েছে। কলকাতায় বিজেপির প্রতিবাদ মিছিল ও বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনের স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ধর্মীয় নেতা, রাজনৈতিক নেতা, তৃণমূলের মমতা ব্যানার্জি, বিরোধীদলীয় প্রিয়াঙ্কা গান্ধীসহ শীর্ষস্থানীয় নেতারা ঘটনার নিন্দা করে মোদী সরকার ‘ব্যবস্থা’ নিলে তাকে সমর্থন জানাবে বলেছেন।
🔘
ক্রমাগত অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপে ভারত এখন কী কী করতে পারে?
অন্যান্য প্রায় সকল দল ভারত সরকারের সঙ্গে একমত হলেও শাসক বিজেপি নিশ্চয়ই বেশি উগ্র পদক্ষেপ নেবে। সোমবার থেকে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি বাংলাদেশে পণ্য পাঠানো ঠেকাতে সীমান্তে ব্যারিকেড দেবে। ভারত সরকারিভাবে এখনই হয়ত বড় পদক্ষেপ নেবে না, তবে রাজ্যগুলোকে দিয়ে নেওয়াবে। আদানিকে চাপ দিয়ে বিদ্যুৎ বন্ধ করতে পারে। পাইপ লাইনের গ্যাস-ডিজেল বন্ধ করতে পারে। ভিসা পুরোপুরি বন্ধ করতে পারে। ফারাক্কার পানি প্রবাহ আরও কমিয়ে দিতে পারে। সরকার পর্যায়ে কূনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন না করলেও দূতাবাসের কর্মিদের ডেকে নিতে পারে। আন্তর্জাতিক স্তরে যেমন কমনওয়েলথ, ইইউ, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় অন্যান্য দেশের কাছে বাংলাদেশের নেতিবাচক ভাবমূর্তী তুলে ধরতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ চারটি পদে আসছেন ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তি, তাদের দিয়ে চাপ দেওয়াতে পারে কারণ তারা তীব্র র‌্যাডিক্যাল ইসলামবিরোধী।
🔘
পরিস্থিতি এই পর্যন্ত থামলে ভালো। তা যদি না হয় তাহলে এয়ারস্পেস বন্ধ করে দেওয়ার মত বড় পদক্ষেপও নিতে পারে। এখানে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ-নির্যাতন হতে থাকলে এবং একটা অরাজনৈতিক সংগঠনের ওপর দমন-পীড়ন অব্যহত থাকলে হয়ত ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমরাও আক্রান্ত হতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব ৫ আগস্টের ঘটনাবলি ও চিন্ময় প্রভুর ঘটনাবলির তীব্র নিন্দা জানিয়ে সরকারের পাশে থাকবে বলেছে।
🔘
এতসব বিপদ এবং বিপন্ন দশায় বাংলাদেশ কেন পড়বে? দেশের জনগণ তো কোনও অপরাধ করেনি! তাহলে তারা কেন বিপদগ্রস্থ হবে? উসকানি, মবলিঞ্চিং, মবভায়োলেন্স, ভারতীয় পতাকা মাটিতে রেখে বা এঁকে তার ওপর দিয়ে চলাচল করার মত হিন্দুবিদ্বেষ, হিন্দু নির্মূল অভিযান করছে ধর্মান্ধ এক্সট্রিমিস্ট, টেরোরিস্টরা। সে দায় সরকার নিলে নিতে পারে, শান্তিপ্রিয় জনগণ কেন নেবে? কেন তারা সরকারের অবিমৃষকারিতার বলি হবে? না। জনগণ সরকারের ভুল নীতির দায় নেবে না। সরকার শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য উগ্র হিন্দুবিরোধীতা, ভারতবিরোধীতাকে উসকে দিতে পারে। দেখেও না দেখার ভান করতে পারে। সেটা তাদের স্ট্রাটিজি, কিন্তু বাংলাদেশের নিরাপরাধ জনগণ কেন তার মাসুল দেবে?
🔘
জনগণ সরকারের বিশেষ গোষ্ঠির পৃষ্ঠপোষকতা করার পরিনতি ভোগ করতে চায় না। করবে না। তাই জনগণের কর্তব্য হবে সরকারের এইসব নীতি ও সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করা। মনে রাখতে হবে নগরে আগুন লাগলে দেবালয় অক্ষত থাকে না। দেশ অস্থির হলে সাধারণ মানুষের জীবন স্থির থাকতে পারে না। ৩০ নভেম্বর ২০২৪। লেখক ও ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট। ফেসবুক থেকে