মে ৫, ২০২৫
লেডিঞ্জে গ্রেন্ড, স্টকহোম,সুইডেন
স্বাস্থ্য

ক্যান্সার চিকিৎসায় এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে ন্যানো রোবট টেকনোলজি!

ক্যান্সার চিকিৎসায় এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন

ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের একদল গবেষকের সফলতা ন্যানো রোবট টেকনোলজি, যা ক্যান্সার চিকিৎসায় এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে!

সুইডেনের নামকরা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের একদল গবেষক সম্প্রতি ক্যান্সার চিকিৎসায় এক যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করেছেন। তারা এমন এক ধরনের উচ্চ প্রযুক্তির ক্ষুদ্র ন্যানো রোবট তৈরি করেছেন, যা প্রাণীর শরীরে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলোকে খুঁজে বের করে ধ্বংস করতে পারে এবং এটি তার আশপাশের সুস্থ কোষগুলোর কোনো ক্ষতি করে না, যা ক্যান্সার চিকিৎসায় এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে বলে মনে করছে সংস্লিষ্ট মহল ।

 

ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন উদ্ভাবিত এই পরীক্ষামূলক ন্যানো রোবটিক টেকনোলজিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক বিশাল অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে। আসলে এই ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট সুইডেনের স্টকহোমের সোলনা অঞ্চলে অবস্থিত। এটি বিশ্বব্যাপী চিকিৎসা গবেষণায় একটি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান এবং এখান থেকেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।

এই প্রজেক্টের সাথে সংশ্লিষ্ট গবেষকেরা জানান যে, এই বিশেষ ন্যানো রোবটটি প্রাণীর শরীরে “স্মার্ট মিসাইল” বা স্মার্ট ক্ষেপণাস্ত্রের মতো কাজ করে। এটি তৈরি করা হয়েছে ডিএনএ এবং অ্যামিনো অ্যাসিড ব্যবহার করে। এই ক্ষুদ্র রোবটটি শরীরের ভেতরে ঘুরে বেড়াতে পারে এবং নির্দিষ্টভাবে ক্যান্সার কোষ বা টিউমার শনাক্ত করে তা ধ্বংসের জন্য কাজ শুরু করে।

গবেষণাটি পরিচালনা করছেন Karolinska Institute-এর অধ্যাপক Björn Högberg ও তাঁর দল। তিনি মেডিকেল বায়োকেমিস্ট্রি ও বায়োফিজিক্স বিভাগের একজন গবেষক। দীর্ঘদিন ধরেই ডিএনএ-ভিত্তিক ন্যানো টেকনোলজি নিয়ে কাজ করছেন তিনি। গবেষণাটি ইউরোপীয় গবেষণা কাউন্সিল (ERC), সুইডিশ রিসার্চ কাউন্সিল, ফিনল্যান্ড একাডেমি এবং নুট ও অ্যালিস ওয়ালেনবার্গ ফাউন্ডেশনের সহায়তায় পরিচালিত হয়।

তারা DNA origami নামক ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করে এমন এক ধরনের স্মার্ট ন্যানো রোবট তৈরি করেছেন, যা শুধু ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে সক্রিয় হয়, কিন্তু সুস্থ কোষের কোনো ক্ষতি করে না। আর বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত এই গবেষণার ফলাফল গত ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞানিক জার্নাল Nature Nanotechnology–তে প্রকাশিত হয়েছে।

এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ডিএনএকে ভাঁজ করে এমন একটি অতি ক্ষুদ্র রোবট বা গঠন তৈরি করা হয়, যা ওষুধ বহন করতে পারে এবং নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে কাজ শুরু করতে পারে। এক্ষেত্রে শরীরের ভালো কোষের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাকে অনেকতাই হ্রাস করে এবং ক্যান্সার চিকিৎসার কার্যকারিতা অনেকতাই বৃদ্ধি করতে সক্ষম বলে দাবিও করা হয়েছে।

ন্যানো রোবটটি দেখতে অনেকটা তালাবদ্ধ একটি ক্ষুদ্র বাক্সের মতো, যার ভেতরে থাকে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার অস্ত্র। এই তালা তখনই খোলে, যখন এটি টিউমার বা ক্যান্সার কোষের আশপাশে পৌঁছে। সাধারণত এই জায়গার pH লেভেল (অ্যাসিডিক মাত্রা) শরীরের অন্য অংশের তুলনায় কম হয়। ন্যানো রোবট সেই অ্যাসিডিক পরিবেশ বুঝে অস্ত্রটি খুলে দেয় এবং ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে শুরু করে।

এই ন্যানো রোবট বা অস্ত্র তৈরি হয়েছে ছয়টি পেপটাইড দিয়ে, যেগুলো একত্রে একটি ষড়ভুজ গঠন করে। এই গঠন ক্যান্সার কোষের “মৃত্যুর রিসেপ্টর” সক্রিয় করে, ফলে কোষটি সংকুচিত হয়ে মারা যায়। ভবিষ্যতে এর কার্যকারিতা বাড়াতে রোবটে আরও উন্নত প্রোটিন বা পেপটাইড যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। যাতে এটি আরও নির্ভুলভাবে ক্যান্সার কোষ খুঁজে বের করে কাজ করতে পারে।

অধ্যাপক হগবার্গ বলেন, এই পেপটাইডগুলো যদি সরাসরি শরীরে প্রয়োগ করা হতো, তাহলে সুস্থ কোষও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারত। তাই তারা এমন একটি ন্যানো রোবট তৈরি করেছেন, যা ওষুধ বা অস্ত্রটি শুধু ক্যান্সার কোষের আশপাশে গিয়ে সক্রিয় করে। এতে শরীরের অন্যান্য অংশে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি অনেক কমে যায়।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, এই প্রযুক্তি ক্যান্সার চিকিৎসায় কেমোথেরাপির চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ ও কার্যকর হতে পারে। কারণ, প্রচলিত কেমোথেরাপি পুরো শরীরে প্রভাব ফেলে এবং অনেক সময় গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। আর সেই ঝুঁকি ন্যানো রোবট টেকনোলজি অনেকটাই হ্রাস করতে পারবে বলে আশাবাদী বিজ্ঞানীরা।

গবেষকরা পরীক্ষাগারে দেখেছেন যে, ন্যানো রোবটটি সাধারণ পরিবেশে (pH ৭.৪) নিষ্ক্রিয় থাকে, কিন্তু ক্যান্সার কোষের অ্যাসিডিক পরিবেশে (pH ৬.৫) এটি সক্রিয় হয়ে ক্যান্সার কোষ শনাক্ত করে ধ্বংস করতে পারে। এই গবেষণাটি ইতোমধ্যেই ইঁদুরের শরীরে পরীক্ষা করা হয়েছে। স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত ইঁদুরদের শরীরে ন্যানো রোবট ইনজেকশন দেওয়া হয় এবং দেখা যায় যে টিউমারের বৃদ্ধি প্রায় ৭০% পর্যন্ত কমে যায়।

গবেষণার প্রথম লেখক ইয়াং ওয়াং জানান, এখন তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আরও জটিল ক্যান্সার মডেল নিয়ে কাজ করা, যেগুলো কিনা মানুষের ক্যান্সার রোগের অনেকটাই কাছাকাছি হতে পারে। এর পাশাপাশি, মানবদেহে প্রয়োগ করার আগে এ প্রযুক্তির সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করা হবে। যা হবে একটি দীর্ঘ মেয়াদি এবং চলমান প্রক্রিয়া।

ক্যান্সার চিকিৎসার এক অভিনব আবিষ্কার হিসেবে এই ন্যানো রোবট প্রযুক্তি বর্তমানে পেটেন্ট করা হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে ক্লিনিক্যাল চিকিৎসায় এটি ব্যবহার করা সম্ভব হয়। যদিও দীর্ঘ মেয়াদি এই গবেষণা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে, বিশেষজ্ঞদের মতে এটি ভবিষ্যতে ক্যান্সার চিকিৎসায় একটি নতুন, নিরাপদ ও কার্যকর দিক খুলে দিতে পারে।
লেখক: সিরাজুর রহমান https://voiceofsweden.online

তথ্যসূত্র:

Karolinska Institute, Interesting Engineering, ScienceAlert https://news.ki.se/nanorobot-with-hidden-weapon-kills-cancer-cells