কবির য়াহমদ : খেয়াল করলে দেখবেন হঠাৎ ‘বিপুল ক্ষমতার অধীশ্বর’ হয়ে যাওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের সমন্বয়কেরা ক্ষমতা হারাতে শুরু করেছেন। এক সপ্তাহের ব্যবধানে তাদের শক্তি-ক্ষয়ের নমুনা দেখা গেছে ঢাকায়।
প্রথমটা রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে পদত্যাগে বাধ্য করতে ব্যর্থতা; দ্বিতীয় ঘটনা জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুর ও আগুনের ঘটনা।
মব সৃষ্টি করে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় দখলের যে পরিকল্পনা সেটা ভেস্তে গেছে। আগে তারা মব সৃষ্টি করে প্রধান বিচারপতি বদলানোর ঘটনা ঘটিয়ে ফেললেও রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে সেটা তারা পারেনি। এখানে স্বরূপে আবির্ভূত হয়েছে রাজনৈতিক শক্তি। রাজনৈতিক দলের সমর্থন ব্যতিরেকে সমন্বয়কেরা যে কাগুজে বাঘ, সেটা এখন প্রমাণিত হয়েছে।
এরপর দ্বিতীয় পরাজয় জাতীয় পার্টির মতো প্রায় নামসর্বস্ব দলের কাছে পরাজয়। ৩১ অক্টোবর হাসনাত আব্দুল্লাহ নামের একজন সমন্বয়ক ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘রাজু ভাস্কর্য থেকে ৭.৩০ এ মিছিল নিয়ে আমরা বিজয়নগরে মুভ করবো। জাতীয় বেইমানদের নিশ্চিহ্ন করতে হবে।’ সারজিস আলম নামের আরেক সমন্বয়কও একইভাবে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলেন জাতীয় পার্টিকে।
হাসনাত ওটা লিখেছিলেন জাতীয় পার্টিকে উদ্দেশ করে। এখানে আবার তিনি তিনবার সময় পরিবর্তন করেন সাড়ে ৭, সাড়ে ৯, এবং সর্বশেষ সাড়ে ৮টায়। অথচ দেখা গেল কী, রাজনীতিতে প্রায় শক্তিহীন জাতীয় পার্টির নেতাকর্মী কর্তৃক তারা প্রতিরোধের মুখে পড়েছেন। যদিও হাসনাত-সারজিসদের উসকানিতে কিছু লোক জাতীয় পার্টি কার্যালয়ে নাশকতা করতে পেরেছি। হামলা-আগুন-ভাঙচুর করতে পেরেছিল, কিন্তু জাতীয় পার্টির মতো দলের কাছ থেকে প্রতিরোধ চেষ্টা অচিন্তনীয় ব্যাপার ছিল।
রাজধানী ঢাকায় জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নেই বললেই চলে, আছে কেবল রংপুর অঞ্চলে। ঢাকায় জাতীয় পার্টির রাজনীতি দৃশ্যমান কেবল হাজী সাইফুদ্দিন আহম্মেদ মিলন নামের একজনের পোস্টারকে কেন্দ্র করেই! মিলনের পোস্টার ঢাকাবাসীকে মনে করিয়ে দেয় জাতীয় পার্টি নামের দলটির অস্তিত্ব।
রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগে বাধ্য করতে এবং জাতীয় পার্টিকে বা তাদের ভাষার ‘জাতীয় বেইমানদের নিশ্চিহ্ন করতে’ লোক জড়ো করতে ব্যর্থ হয়েছেন সমন্বয়কেরা। ওখানে হাজারো লোক হয়নি। ইউটিউবার, ফেসবুক কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও সাংবাদিক ব্যতিরেকে ওখানে শতাধিক লোকও হবে কিনা প্রশ্ন। পর পর দুই ঘটনায় লোক জড়ো করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে, এবং এর ফলে ব্যর্থ হয়েছে দাবি আদায়ে, শক্তি প্রদর্শনে।
জুলাই-আগস্টে যাদের ডাকে লাখ লাখ লোক রাস্তায় নেমেছিল, এখন কেন তাদের ডাকে শখানেক লোকও জড়ো হচ্ছে না? কারণ একটাই, আগে কে ডেকেছে তার দিকে নজর ছিল না কারো। যাদের কানে ডাক গেছে তারা ব্যক্তি দেখেনি, শুনেছে কেবল ডাকটাই। ওটা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ডাক। সেই ডাকে সাড়া দিয়েছে তাই বিএনপি-জামায়াত-ডানপন্থী-বামপন্থী-উগ্রপন্থী-মধ্যপন্থীদের সবাই। তাই লাখো লোকের সমাগম ঘটেছে রাজপথে। এখন সে অবস্থা নেই।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারিয়েছে। যার যার লোক তার তার ঘরে ফিরে গেছে। বিএনপি লোকেরা ফিরেছে মূল নেতৃত্বের কাছে। জামায়াত নিজেদের রাজনীতিতে ফিরেছে। ডানপন্থী-বামপন্থীসহ সবাই ফিরেছে নিজ নিজ রাজনীতিতে অথবা দর্শকের ভূমিকায়। ফলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের সমন্বয়কেরা হয়ে পড়েছে কেবল কাগুজে বাঘ। তারা গর্জন দিচ্ছে ঠিক, কিন্তু গর্জনটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয়ে পড়েছে অন্তঃসারশূন্য। আগে যেখানে তাদের সিদ্ধান্তে সবাই চালিত হতো, এখন তাদেরকে চালিত হতে হচ্ছে বিএনপির সিদ্ধান্তে। বিএনপি রাষ্ট্রপতির পদত্যাগে সাংবিধানিক সংকট চায় না বলে সমন্বয়কদের তর্জন-গর্জনের সব অর্থহীন হয়ে পড়েছে।
সমন্বয়কেরা এখন একা। তাদের গলার আওয়াজ আছে ঠিক, কিন্তু এসব কাজে লাগছে না। দুই-দুইটা ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে চাঁদের মতো তাদেরও নিজস্ব কোন আলো নেই, তারা অন্যের বিশেষ করে বিএনপির শক্তিতে ছিল শক্তিমান। বিএনপি তাদের সঙ্গে না থাকলে তারা আদতে কিছুই না।
দেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নাই বলে বিএনপি সমন্বয়কদের গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না। আওয়ামী লীগের রাজনীতি দেশে ফিরতে শুরু করলে বিএনপি সমন্বয়কদের ‘ব্যবহার’ করতে শুরু করবে।
জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের সমন্বয়কেরা ছিলেন ‘প্রিন্সিপাল’, এখন তারা ‘রিজার্ভ ফোর্স’। আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলনে সমন্বয়কদের ‘রিজার্ভ ফোর্স’ ছিল বিএনপিসহ অপরাপর দল, এখন পরিস্থিতির বদল হয়েছে। আগের প্রিন্সিপাল এখন রিজার্ভ ফোর্সে পরিণত; আগের রিজার্ভ ফোর্সের প্রধান দল বিএনপি এখন প্রিন্সিপালের ভূমিকায়। ‘রিজার্ভ ফোর্স’ সমন্বয়কদের ব্যবহারের প্রয়োজন দেখছে না এখন বিএনপি। লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ফেসবুক থেকে