• এনসিপি-বিএনপি-জামায়াত-আ.লীগের সবাই আছেন রিয়াদের ফ্রেমে
• নির্বিঘ্নে অপকর্ম চালাতে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতেন ঘনিষ্ঠ ছবি
• রিয়াদকে নব্য সাহেদ বলছেন নেটিজেনরা
• এদের শেকড় অনেক গভীরে: উমামা ফাতেমা
• গ্রেফতারের পর সংগঠন থেকে বহিষ্কার
২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় একাধিক শিক্ষার্থী চাঁদাবাজির অভিযোগে পুলিশের হাতে আটক হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আব্দুর রাজ্জাক সোলাইমান রিয়াদ। তিনি সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ফোরামের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। রিয়াদের গ্রেফতারের পর সামাজিকমাধ্যমে তার বিভিন্ন ছবি ছড়িয়ে পড়ে। এসব ছবিতে তাকে বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা, বিএনপি, এনসিপি এবং জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) অংশের নেতাদের সঙ্গে দেখা যায়।
রিয়াদের ছবি ও পরিচয়ের এই সমান্তরাল বিস্তার নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা। আন্দোলন, রাজনীতি এবং অপরাধ—তিনটি শব্দ ঘিরে তৈরি হয়েছে নতুন বিতর্ক।
শুধু বিএনপি, এনসিপি কিংবা জাতীয় পার্টির নেতাই নয়, আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গেও দেখা গেছে রিয়াদকে। যদিও গত জুলাই মাসেই আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা ছিল তার। আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা কাদের মির্জার সঙ্গেও তাকে ফ্রেমবন্দি হতে দেখা গেছে। এই ছবিগুলো তার সচেতন উপস্থিতির ইঙ্গিত দেয়।
শেখ মুজিবুর রহমানের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে তোলা একাধিক মুহূর্ত—রিয়াদ নিজেই এক সময় পোস্ট করেছিলেন তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে। সেই পোস্টগুলো এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিকমাধ্যমে। এই দৃশ্যপট দেখে অনেকেই দ্বিধায় পড়েছেন। প্রশ্ন তুলছেন, এই রিয়াদ আসলে কার লোক?
কারও কারও ভাষ্য, সে প্রতারণায় অভিযুক্ত সাহেদেরই নতুন সংস্করণ। পরিচয়, আদর্শ আর অবস্থান—কোনোটিই তার স্থির নয়। বরং স্বৈরাচারবিরোধী সাহসী পরিচিতির আড়ালে যেন আবারও দেখা মিলছে ধূর্ত এক প্রতারকের।
এদিকে সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আহমেদের বাসায় গিয়ে চাঁদা দাবির অভিযোগে যাদের পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে তিনজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা। এই তিনজনকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে সংগঠন থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করেছে সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ফোরাম।
অন্যদিকে, গ্রেফতার হওয়া কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক জানে আলম অপু ও সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বিন সুলাইমানকে বহিষ্কারের কথা জানিয়েছে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ। তাদের বহিষ্কার আদেশে স্বাক্ষর করেছেন সংগঠনটির আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার ও সদস্যসচিব জাহিদ আহসান।
বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল
রিয়াদ গ্রেফতার হওয়ার পর, তার বিরুদ্ধে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসছে। কে কার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ছিল, আর কীভাবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা চাঁদাবাজিতে জড়াল— এ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন আন্দোলনের শীর্ষ পর্যায়ের অনেকেই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতিমা বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন তার ফেসবুক পোস্টে। তিনি লিখেন, আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ৫ জনের চাঁদাবাজির খবর শুনে অনেকেই এমনভাবে অবাক হওয়ার অভিনয় করছেন, যেন তিনিই সবচেয়ে কম অবাক হয়েছেন।
তার ভাষায়, এই ছেলেদের বহুদিন ধরে নেতাদের পেছনে প্রটোকল দিতে দেখা গেছে। সচিবালয়, মিছিল-মিটিং কিংবা মারামারিতে তারা ছিলেন সমন্বয়কারীদের ঘনিষ্ঠ সহচর। তিনি আরও জানান, গুলশান-বনানী গ্যাং কালচারের অনেক অভিযোগ আগেও অভ্যন্তরীণভাবে তাদের বিরুদ্ধে ছিল।
উমামা তার পোস্টে লিখেছেন, রিয়াদ গত ডিসেম্বরে রূপায়ন টাওয়ারে আমার সামনে অত্যন্ত উশৃঙ্খল আচরণ করেছিল। আমরা মেয়েরা তাকে থামানোর চেষ্টা করলে, সে আমাদের ওপর চড়াও হয়। সেই ঘটনার পর তার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, তার বিরুদ্ধে হুমকি, মারামারি এবং চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে। তখন আমি অবাক হইনি, কারণ ততদিনে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে এমন ধরনের মানুষের উপস্থিতি সর্বত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তারা রূপায়ন টাওয়ারে অবাধে আসা-যাওয়া করত। দুর্নীতি বা অসততার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানালে, সে সময় পিনড্রপ সাইলেন্সই পাওয়া যেত। আমি নিজে চোখের সামনে দেখতাম কীভাবে এসব লোকজন দিনের শেষে এক্সেস পেয়ে যেত। আজ, মাস কয়েক পর এই প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকালে, কোনো ভাষা খুঁজে পাই না। প্রত্যেকে নিজের মতো করে এই প্ল্যাটফর্মকে নষ্ট করেছে।
তিনি মন্তব্য করেছেন, এবার প্রথমবারের মতো চাঁদাবাজি করতে গিয়ে তারা পুলিশের হাতে ধরা পড়ল। সঠিকভাবে খোঁজ নিলে বুঝবেন, এদের শেকড় অনেক গভীরে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের আরেক সক্রিয় নেতা আব্দুল্লাহিল বাকি। রিয়াদের সঙ্গে বিভিন্নজনের ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, চাঁদাবাজির কৌশলটা দেখেন। প্রভাবশালী যার সাথেই দেখা হয়, তার সঙ্গেই ছবি তোলে। নাহিদ, হাসনাতদের সঙ্গেও ছবি তুলেছে। কারণ এসব ছবি দেখিয়ে বড় বড় ডিল করা যায়, ধান্ধার।
তিনি আরও লিখেছেন, এই ছেলেটা নতুন বাইক নিয়ে ঘুরে, নতুন নতুন আইফোন কিনে, তার সার্কেলের সবাই লাক্সারিয়াস লাইফ কাটাচ্ছে। কিন্তু সোনাচান ভেবেছে, কখনও ধরা খাবে না। যার-তার সঙ্গে বেয়াদবি করে, কাউকে সম্মান দিয়ে কথা বলে না।
তিনি মন্তব্য করেছেন, বারোটা তোমার বেজে গেছে, সোনাচান। যার যার কাছ থেকে চাঁদাবাজি করেছো, ভুক্তভোগীরা আস্তে আস্তে সব ফাঁস করবে। তার মতে, সমন্বয়ক নামে যারা প্রভাব বিস্তার করতে চাইবে, তাদের পুলিশে দেওয়া উচিত।
রিয়াদ সম্পর্কে আব্দুল্লাহিল বাকি আরও লিখেছেন, এই ধান্ধাবাজকে আমি নয় মাস আগেই চিনেছিলাম। কিন্তু বাইম মাছের মতো পিছলে গেছিল। তখনই ছবিগুলো সেভ করে রাখছিলাম। শুধু হাতে-নাতে প্রমাণের অপেক্ষা করছিলাম। পরে কেমনে কেমনে যেন সে বড় বিপ্লবী বনে গিয়েছিল।
যাদের ফ্রেমবন্দি করেছেন চাঁদাবাজ রিয়াদ
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ছবিগুলোতে দেখা গেছে, রিয়াদ সরকারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কমিটিতে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে ছিল। এই প্ল্যাটফর্মটি সে চাঁদাবাজি ও অন্যায় কর্মকাণ্ডে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। একক ছবিতে তাকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টার সঙ্গেও দেখা গেছে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহর সঙ্গেও একাধিক ছবি রয়েছে তার। অনেকেই মন্তব্য করছেন, রিয়াদ এসব ছবি ব্যবহার করে একটি গ্রুপ তৈরি করেছিল। এই ছবিগুলোর মাধ্যমে সে নিজের অপকর্মের পথ মসৃণ রাখত।
সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং বিএনপি নেতা লুৎফুজ্জামান বাবর, ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থের সঙ্গেও রিয়াদকে দেখা গেছে ঘনিষ্ঠভাবে। এছাড়া জামায়াত নেতা ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদের সঙ্গেও ছবিতে উপস্থিতি রয়েছে তার।
রিয়াদ যাদের সঙ্গেই ছবি তুলেছে, তাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। বেশিরভাগ ছবিতেই দেখা যায়, নেতারা রিয়াদের কাঁধে হাত রেখে ছবি তুলছেন। এইভাবে নিজের ঘনিষ্ঠতা প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলেন রিয়াদ, যিনি বর্তমানে পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরিচালিত ফেসবুক পেজে রিয়াদদের বিষয়ে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে আমরা বারবার এই ধরনের আন্দোলনে জড়িতদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে অনুরোধ করেছি। জুলাই আন্দোলনে এদের কেউ কেউ অংশ নিয়েছিল, তবে পরবর্তীতে তাদের নৈতিক অবনতি ঘটে এবং তারা বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে।
সাহেদ—করোনাকালে এই নামটি দেশে প্রতারণার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিল। ভুয়া করোনা সনদ বিক্রি থেকে শুরু করে নানা অনিয়মের দায়ে যখন তাকে গ্রেফতার করা হয়, তখনই সামনে আসে তার আরেক পরিচয়। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছবি, সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ ভঙ্গিমায় তোলা মুহূর্ত, আর টেলিভিশনের টকশোতে নীতির কথা বলার দৃশ্য—সব মিলিয়ে তার অবস্থান ছিল আলোচিত ও বিভ্রান্তিকর। সেই পরিচিতি আর বিশ্বাসযোগ্যতাকে পুঁজি করেই সাহেদ গড়ে তুলেছিলেন এক নিখুঁত প্রতারণার নেটওয়ার্ক।
অনেকদিন পর আবারও সামনে এসেছে সাহেদের মতো নতুন চরিত্র। রাজধানীতে সাবেক এক সংসদ সদস্যের বাসায় চাঁদাবাজির অভিযোগে তাকে আটক করা হয়েছে। পরিস্থিতি, প্যাটার্ন আর পরিচিতি—সব মিলিয়ে যেন পুরনো সাহেদেরই প্রতিচ্ছবি।