আগস্ট ২০, ২০২৫
লেডিঞ্জে গ্রেন্ড, স্টকহোম,সুইডেন
বাংলাদেশ

“অসমাপ্ত আত্মজীবনী” বঙ্গন্ধুর নিজের হাতে লেখা-তথ্য এবং রেফারেন্স দিয়ে ব্যাখ্যা

“অসমাপ্ত আত্মজীবনী” বঙ্গন্ধুর নিজের হাতে লেখা-তথ্য এবং রেফারেন্স দিয়ে ব্যাখ্যা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” (The Unfinished Memoirs) বইটি তাঁর নিজের হাতে লেখা, এবং তিনি ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে কারাগারে থাকাকালীন এটি নোটবুকে লিখেছিলেন। এই বইটির আবিষ্কার, প্রকাশনা এবং অথেনটিসিটি নিয়ে ঐতিহাসিক রেকর্ড এবং অফিসিয়াল সোর্সগুলো স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে এটি বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব লেখা। সম্প্রতি কিছু মিডিয়ায় প্রচারিত দাবি যে এটি সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীর হাতে লেখা, তা মিথ্যা এবং ফ্যাব্রিকেটেড। এই দাবিগুলো আসলে অন্য একটি বই—”Secret Documents of Intelligence Branch on Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman”—এর সাথে কনফিউজ করে তৈরি করা হয়েছে, যা জাবেদ পাটোয়ারী এবং তার টিমের সাথে যুক্ত ছিল। নিচে বিস্তারিত তথ্য এবং রেফারেন্স দিয়ে ব্যাখ্যা করছি।

 

১. “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” বইটির উৎপত্তি এবং লেখার প্রক্রিয়া:
– **লেখার সময় ও প্রেক্ষাপট**: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৭-১৯৬৯ সালে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে রাষ্ট্রীয় বন্দী হিসেবে থাকাকালীন এই আত্মজীবনী লিখেছেন। তিনি তাঁর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের উৎসাহে এবং কারাগারে একাকী সময় কাটানোর জন্য এই লেখা শুরু করেন। তিনি চারটি নোটবুকে হাতে লিখে তাঁর জীবনের প্রথম দিকের ঘটনা, রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং বাংলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। এই নোটবুকগুলো তাঁর হাতের লেখায় ছিল, যা পরবর্তীতে প্রকাশনার সময় যাচাই করা হয়েছে।
হস্তলিখিত নোটবুকের হস্তান্তর**: বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর এই নোটবুকগুলো তাঁর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনিকে দেন, যিনি তাঁর বাসায় টাইপরাইটারে এগুলো টাইপ করার জন্য দায়িত্ব নেন। এই প্রক্রিয়াটি ১৯৬৯-১৯৭০ সালের দিকে শুরু হয়েছিল।

২. বইটির আবিষ্কার ও প্রকাশনা:
– **আবিষ্কার**: ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু এবং শেখ ফজলুল হক মনির হত্যার পর এই নোটবুকগুলো হারিয়ে যায়। ২০০৪ সালে শেখ মনির স্ত্রী বেবি মৌদুদ এই নোটবুকগুলো তাঁদের বাসার একটি ড্রয়ারে আবিষ্কার করেন। নোটবুকগুলো তখন সময়ের প্রভাবে বিবর্ণ এবং ভঙ্গুর হয়ে গিয়েছিল।

প্রকাশনার প্রক্রিয়া**: শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা এবং বেবি মৌদুদ নোটবুকগুলো থেকে কনটেন্ট সংগ্রহ করেন। শেখ হাসিনা বইটির প্রিফেস লেখেন, এবং শেখ রেহানা এর নামকরণ করেন। বইটি ২০১২ সালের ১২ জুন দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (UPL) থেকে প্রকাশিত হয়। এটি ১৪টি ভাষায় অনুবাদিত হয়েছে এবং ২০২০ সালে ব্রেইল ভার্সনও প্রকাশিত হয়।

ড্রাফট তৈরি**: নোটবুকগুলো থেকে ড্রাফট তৈরির কাজ ২০০৭ সালে সম্পন্ন হয়, যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল না। এটি প্রমাণ করে যে বইটি রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ফ্যাব্রিকেট করা হয়নি।

অথেনটিসিটি যাচাই**: বইটির হস্তলিখিত নোটবুকগুলো বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে সংরক্ষিত ছিল, যা ইউনুস সরকার ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। অনেক আগেই এই নোটবুকগুলোর হস্তলেখা বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেছেন যে এটি বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে লেখা।

 

৩. জাবেদ পাটোয়ারীর সাথে সম্পর্কিত মিথ্যা দাবি:
– **দাবির উৎস**: সম্প্রতি কিছু গণমাধ্যম, বিশেষ করে চ্যানেল ২৪-এর একটি রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে জাবেদ পাটোয়ারী এবং তার ১২৩-সদস্যের টিম “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” লিখেছেন এবং এর জন্য তারা টাকা ও ফ্ল্যাট পেয়েছেন। এই দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর।

– **টাইমলাইন অসঙ্গতি**: জাবেদ পাটোয়ারী ২০১৮-২০২০ সালে পুলিশের আইজিপি ছিলেন এবং তার আগে তিনি স্পেশাল ব্রাঞ্চের অ্যাডিশনাল আইজি ছিলেন। “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়, যখন জাবেদ পাটোয়ারী এই ধরনের কোনো প্রজেক্টের সাথে জড়িত ছিলেন না। এই টাইমলাইনই প্রমাণ করে যে তিনি বা তার টিম এই বইটি লেখেনি।

 

– **ভুল বইয়ের সাথে কনফিউশন**: দাবিটি আসলে “Secret Documents of Intelligence Branch on Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman” নামক আরেকটি বইয়ের সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। এই বইটি ১৪ খণ্ডের একটি সিরিজ, যা ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়। জাবেদ পাটোয়ারী, তৎকালীন স্পেশাল ব্রাঞ্চ প্রধান হিসেবে, এই প্রজেক্টের তত্ত্বাবধান করেছিলেন। তাঁর ২২-সদস্যের টিম ৪৮,০০০ গোপন ডকুমেন্ট অ্যানালাইজ করে এই বই সংকলন করেছিল। এই বইটি বঙ্গবন্ধুর জীবনের উপর গোয়েন্দা রিপোর্টের সংকলন, আত্মজীবনী নয়। এটির প্রিফেস এবং অ্যাকনলেজমেন্টে জাবেদ পাটোয়ারী এবং তার টিমের নাম উল্লেখ আছে।

 

– **মিথ্যা দাবির উদ্দেশ্য**: চ্যানেল ২৪-এর রিপোর্টার মাসুদুর রহমান রানার রিপোর্টটি বঙ্গবন্ধুর লেগাসিকে ডিফেম করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে বলে বিশ্লেষণে দেখা গেছে। এই রিপোর্টারের পুরনো ফেসবুক পোস্টে দেখা যায়, তিনি একসময় বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা করতেন, যা এই রিপোর্টের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করে।

– **ডিবাঙ্কিং**: একাধিক সোর্স এই দাবিকে “ননসেন্স প্রোপাগান্ডা” হিসেবে উল্লেখ করে ডিবাঙ্ক করেছে। উদাহরণস্বরূপ, X প্ল্যাটফর্মে Redowan Ibne Saiful-এর পোস্টে বিস্তারিতভাবে এই কনফিউশন এবং ফ্যাব্রিকেশন ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

 

৪. অথেনটিসিটির অতিরিক্ত প্রমাণ:
– **হস্তলিখিত নোটবুক**: বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে নোটবুকগুলো সংরক্ষিত আছে। এগুলোর হস্তলেখা বঙ্গবন্ধুর সাথে মিলে যায়, যা বিশেষজ্ঞরা যাচাই করেছেন।

– **সমকালীন সাক্ষ্য**: বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী এবং পরিবারের সদস্যদের বিবরণ থেকে জানা যায়, তিনি কারাগারে থাকাকালীন এই লেখা লিখেছিলেন। শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানার বিবরণ এটি নিশ্চিত করে।

– **প্রকাশকের বিবৃতি**: দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (UPL) এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেমোরিয়াল ট্রাস্ট বইটির অথেনটিসিটি নিশ্চিত করেছে।

– **আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি**: বইটি ১৪টি ভাষায় অনুবাদিত হয়েছে এবং ইউনেস্কোর মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এটিকে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

 

৫. রেফারেন্স এবং সোর্স:
মিথ্যা দাবির ডিবাঙ্কিং।
– **বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর**: নোটবুকগুলোর অথেনটিসিটি যাচাইয়ের জন্য এই জাদুঘরের সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
– **UPL প্রকাশনার বিবৃতি**: বইটির প্রকাশনা বিবরণ এবং প্রিফেসে শেখ হাসিনার লেখা পড়লে অথেনটিসিটি স্পষ্ট হয়।
– **Secret Documents of Intelligence Branch**: এই বইটির প্রিফেস এবং অ্যাকনলেজমেন্টে জাবেদ পাটোয়ারীর ভূমিকা উল্লেখ আছে, যা “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

উপসংহার:
“অসমাপ্ত আত্মজীবনী” বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজের হাতে লেখা, যা তিনি কারাগারে থাকাকালীন ১৯৬৭-১৯৬৯ সালে লিখেছিলেন। জাবেদ পাটোয়ারীর সাথে এই বইটির কোনো সম্পর্ক নেই। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রচারিত দাবি মিথ্যা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এটি “Secret Documents of Intelligence Branch” বইয়ের সাথে কনফিউজ করে তৈরি করা হয়েছে। উপরের তথ্য এবং রেফারেন্সগুলো এই দাবির মিথ্যা প্রকৃতি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে।