জানুয়ারি ২২, ২০২৫
লেডিঞ্জে গ্রেন্ড, স্টকহোম,সুইডেন
বাংলাদেশ মতামত

পাকিস্তানের পণ্যবাহী জাহাজ : কাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করবেন?

মনজুরুল হক : স্বাধীনতার ৫৩ বছর বছর পর পাকিস্তানের একটি পণ্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছিল। সেই জাহাজ আসা নিয়ে ছড়িয়েছে বেশুমার গুজবের ডালপালা। গজব ছড়ানোর জন্য যদিও বাংলাদেশ সরকার এবং মিডিয়া দায়ী। প্রতিদিনই বন্দরে একাধিক দেশের জাহাজ নোঙ্গর করে। কোনও জাহাজ নিয়ে জনমনে এমন প্রশ্নে উদ্রেক হয় না। তাহলে এটার বেলায় হলো কেন? হলো জাহাজটির আগমন সংবাদ ‘চেপে যাওয়ার কারণে’।
📍
৫ আগস্টের ক্ষমতা পরিবর্তনের আগে তৎকালিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা নাহিদ একাধিকবার সশস্ত্র সংগ্রামের হুমকি দিয়েছিলেন। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে তারা কাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করবেন? অস্ত্র পাবেন কোথায়? সেই সূত্র ধরে এখন মনে করা হচ্ছে চট্টগামে যে জাহাজটি ভিড়েছে তাতে পাকিস্তান থেকে বিপুল পরিমানে অস্ত্রশস্ত্র এসেছে! সেই সন্দেহ আরও বেগবান হয় ৫ আগস্টে নংসিংদী কারাগার ভেঙে শত শত কয়েদিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল এবং সেখানকার অস্ত্র লুট হয়েছিল। যা এখনও উদ্ধার করা যায়নি। তার উপর পাকিস্তান ডিফেন্স ফোর্সেস এর এক পোস্টে ‘মোস্ট আর্জেন্ট’ শিরোনামে বাংলাদেশে ৪০ হাজার রাউন্ড লং রেঞ্জ আর্টিলারি শেল, ৪০ টন আরডিএক্স, এবং ২৯০০ হাই ইন্টেনসিটি প্রজেক্টাইল সাপ্লাই দেওয়া হচ্ছে। এসব থেকেই ধরে নেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশের জঙ্গীদের জন্য এসব অস্ত্র এসেছে।
📍
এই খবরে বাংলাদেশের জঙ্গীরা এবং তাদের প্রতি ‘সফট’ অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন মহলে আনন্দ এবং উল্লাসের ঢেউ উঠেছে। ভাবখানা এমন এইবার ‘চির শত্রু’ ভারতকে দেখে নেব। এই পক্ষের লোকজনের মনে বিশ্বাস জন্মেছে ভারতকে শায়েস্তা করার জন্য ‘প্রাণের দোসর’ পাকিস্তান মুফতে অজস্র অস্ত্রশস্ত্র দিচ্ছে। গুজবানন্দে তারা গজওয়াতুল হিন্দও কায়েম করে ফেলছেন ধরে নিয়েছিলেন।
📍
এর বিপরীতে সরকারবিরোধী বিভিন্ন দল বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সমর্থক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক সদস্যদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে তারা নিরাপত্তার ভয় পাচ্ছেন। মনে করছেন দেশে শিগগিরই বিরাট কোনো ব্লাডশেড ঘটতে যাচ্ছে। এই সংবাদ নিয়ে একাধিক বন্ধু আমার কাছে জানতে চেয়েছেন কারণ, তারা মনে করেন আমি বিশ্বের নানা সংবাদ মাধ্যম ঘেটে খবর সংগ্রহ করি।
📍
পাশাপাশি ভারতেও গুজব ছড়িয়েছে। সেখানে মনে করা হচ্ছে ভারতের ‘সেভেন সিস্টার’ অশান্ত করেতে সেখানকার উগ্রবাদী জঙ্গী তথা স্বাধীনতাকামীদের জন্যই এসব অস্ত্র বাংলাদেশ হয়ে এসেছে। এ নিয়ে ভারতেও তোলপাড় শুরু হয়েছে। ভারতীয় একাধিক সংবাদ মাধ্যমে এই সংবাদ ফলাও করে প্রকাশ হয়েছে।
📍
প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে এই অস্ত্র বিষয়ক বিস্তৃত সংবাদটি পুরোটাই গুজব। আর গুজবটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের হিরন্ময় নীরবতা ও মিডিয়ার বিস্ময়কর ‘চেপে যাওয়া’র কারণে। বিষয়টিকে কেন গুজব বলছি এবার সেই আলোচনায় যাওয়া যাক।
📍
প্রথমতঃ এটাই ৫৩ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে প্রথম জাহাজের আগমন নয়। এর আগে ২০২২ সালের আগস্ট মাসে চীনে তৈরী পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজ পিএনএস তৈমুর হঠাৎ করেই চট্টগ্রাম বর্হিনঙ্গরে এসেছিল। সেই জাহাজটিকে বন্দরে ভেড়ার অনুমতি দেয়নি তৎকালিন সরকার। কেন দেয়নি? কারণ, জাহাজটি বাংলাদেশ সরকারের পারমিশন নিয়ে আসেনি। এমনকি তারা পাকিস্তান সরকারের পারমিশনও নেয়নি। এখানে ভেড়ার অনুমতি না পেয়ে সেটি পরে ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ায় যৌথ মহড়ায় যোগ দিতে চলে যায়। অর্থাৎ এই উয়ান জিয়াং ফা ঝান নামক জাহাজটিই ৫৩ বছরে প্রথম নয়।
📍
দ্বিতীয়তঃ বলা হয়েছে কিছুদিন আগে এনবিআর থেকে একটি রুল জারি করে বলা হয়েছে ‘কোনো জাহাজের পণ্য খালাসের আগে ইন্সপেকশন করা যাবে না’। অর্থাৎ কী পণ্য আছে তা পরীক্ষা ছাড়াই পোর্টে খালাস হতে পারবে। বলাবাহুল এধরণের কোনো এসআরও এনবিআর জারি করেনি। নিয়ম অনুযায়ী বর্হিনঙ্গর, মূল জেটিতে থাকা অবস্থায় একাধিক এজেন্সি কর্তৃক দুবার এবং খালাসের পর সাধারণ কাস্টমস ও কাস্টমস ইন্টেলিজেন্ট কায়িক পরীক্ষা করে। তাই জাহাজে অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ থাকার প্রশ্ন আসে না।
📍
তৃতীয়তঃ পাকিস্তান ডিফেন্স থেকে যে বার্তা ভাইরাল হয়েছে সেটা ২৯ আগস্টের। সে সময় দুই দেশের মধ্যে অস্ত্র কেনা-বেঁচার কথাবার্তা চলেছিল। সেই খবরটিই কেউ উত্তেজনা বাড়ানোর জন্য প্রকাশ করেছে।
📍
চতুর্থতঃ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় আকু পেমেন্ট দেওয়া যাচ্ছে না। প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। সেখানে এই মুহূর্তে এত টাকার অস্ত্র কেনার যুক্তি নেই। যদি বাকিতে কেনা হয়? সে সম্ভবনাও নেই কারণ, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা এমন না যে তারা বাকিতে পণ্য বিক্রি করতে পারে।
📍
পঞ্চমতঃ জাহাজটি চীনে তৈরি, পানামার পতাকাবাহী বাণিজ্যিক জাহাজ। করাচী বন্দর ছেড়ে দুবাই-কলম্ব হয়ে চট্টগ্রামে এসেছে। যদি জাহাজে অস্ত্র-গোলাবারুদ থাকতই তাহলে সেসব ইনবোর্ড হওয়ার আগেই ভারতের NIA, RAW, বা NSG জানবে না তা হতে পারে না। যেখানে ভারতের তেলেঙ্গানা, কোইম্বাটোর, অসম, ঝাড়খণ্ড, শিলিগুড়িতে একাধিক বাংলাদেশি সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে জঙ্গী সন্দেহে। সেখানে একটা জাহাজ বোঝাই হয়ে বাংলাদেশে অস্ত্র আসছে আর তারা জানতে পারছে না এ হতেই পারে না।
📍
ষষ্ঠতঃ বাংলাদেশ সরকার এবং মিডিয়া না হয় ‘চেপে’ গেছে। তা বলে এতবড় একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে আর বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি মিডিয়া নিশ্চয়ই চুপ করে আছে সেটাও অসম্ভব।
📍
সপ্তমতঃ যে জাহাজটি এসেছিল ১১ তারিখে এবং পণ্য খালাস করে ১২ তারিখে চলেও গেছে, তার শিপিং এজেন্ট আওয়ামী লীগের প্রাক্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর মালিকানাধীন। একজন লীগ মন্ত্রীর শিপিং এজেন্সির তত্ত্ববধানে এতবড় অস্ত্রের চালান আসবে তাও আবার এই সময়ে? ভাবা যায় না।
সুতরাং ধরে নেওয়া যায় পাকিস্তানি জাহাজে অস্ত্র এসেছে সেই ২০০৪ সালের মত। ব্যাপারটা পুরোপুরি গুজব।
📍
তবে আমরা বাংলাদেশে বসে বিভিন্ন তথ্য উপাত্তযোগে যতোই গুজব বলি না কেন, ভারত অত সহজে বিষয়টি ডিসমিস হয়েছে মনে করবে না সেটা বলাই যায় কারণ, এখন পর্যন্ত কী পণ্য এসেছে তার বিবরণ বাংলাদেশ সরকার দেয়নি। এমনকি শীর্ষ সংবাদ মাধমেও এই খবর প্রচার হয়নি। একটি ইংরেজি দৈনিক এবং একটি মধ্যমসারির বাংলা পের্টালেই শুধু খবর হয়েছে। তাই সাসপিসিয়াসলি ভারত ভাবতেই পারে- ৩৭০টি কন্টেইনার বোঝাই হয়ে হয়ত জাহাজে খাদ্য পণ্য ছিল, হয়ত ড্রাগ ছিল, নয়ত কলকব্জা বা মেশিনারী ছিল, কিংবা অস্ত্র-গোলবারুদও থাকতে পারে। আমাদের দেশে এ নিয়ে কালচার না হলেও ভারত বসে থাকবে না, বিশেষত তার পূর্বাঞ্চলের অস্থিরতার বিষয়ে। সেটা হয়ত আমরা আরও পরে জানতে পারব।
📍
বাংলাদেশের মিডিয়া ‘বার্তা২৪’-এ শুধু এতটুকুই খবর ছাপা হয়েছেঃ “প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের নৌ পথে সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হলো। সোমবার (১১ নভেম্বর) পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে পণ্যবাহী একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, পানামার পতাকাবাহী জাহাজটির নাম উয়ান জিয়াং ফা ঝান। করাচি থেকে আসা এ জাহাজে ৩৭০ একক কনটেইনার পণ্য ছিল। বাংলাদেশে জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছে সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান।
বুধবার (১৩ নভেম্বর) ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। সেখানে বলা হয়, ‘করাচি থেকে সরাসরি পণ্যবাহী একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে, যা ছিল দুই দেশের মধ্যে প্রথম সরাসরি সামুদ্রিক সংযোগ। এ যাত্রা দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে তুলে ধরেছে।“
📍
অতএব পাকাপাকিভাবে দেশে জঙ্গী আক্রমণের মাধ্যমে দেশ দখল করে ‘ইসলামি বাংলাদেশ’ কায়েমের বাসনায় উৎফুল্ল হয়ে ধেই ধেই করে নেত্য করার কিছু নেই যেমনি, তেমনি দেশে অস্ত্র আসছে, ওরা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ দখল করে নেবে ভেবে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে মাতম করারও কিছু নেই। বাংলাদেশে উপরকিকাঠামোতে ইসলামি জঙ্গীদের ‘পেট্রোনাইজার’ অন্তর্বর্তী সরকার আইন জারি করে, আসকারা দিয়ে, মদদ দিয়ে ইসলামি জজবা জারি করার টেস্ট কেস করতে পারে। তা বলে দেশের প্রধান সমস্যা ওভারলুক করে দেশে শরিয়া জারি করার জিও-পলিটিক্যাল আর্টিফ্যাক্ট এইমুহূর্তে নেই। আবার তার মানে এটাও নয় যে তারা পারবে না বলে দেশের গণতন্ত্রপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ নাকে তেল দিয়ে ঘুমাবেন। টু বি অ্যালার্ট ফর সারভাইভাল। টুবি ডিটারমাইন্ড ফর উইন। বাংলাদেশটা কারও বাপ-দাদার দয়ার দান নয় যে ইচ্ছামত ভাগ-বাটোয়ারা করে নেবে।
১৬ নভেম্বর ২০২৪। লেখক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। ফেসবুক থেকে