ভওস : জুলাই-আগস্টে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা কোটা সংস্কার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশে একরকম বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। শতশত আওয়ামী লীগ বা সরকার বিরোধী দল বা গোষ্ঠীর ওপর একের পর এক আক্রমণ হতে থাকে। ঐতিহাসিক ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবঙ্গুর ম্যুরাল ভেঙে ফেলা হয়। সাতই মার্চের ভাষণ, বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক মনে না করা, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে চলা ভাস্কর ভেঙে ফেলা, সরকারের উপদেষ্টাদের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু আদর্শবিরোধী অবস্থান নিতে দেখা যায়।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতি-মানুষ দিশেহারা প্রায়। মব সন্ত্রাস করে মানুষ হত্যার উল্লাস নৃত্য চলে। যানজটে অচল ঢাকা মহানগর। কিন্তু এর কোনোটাই প্রতিরোধ বা প্রতিকারে সরকারের সক্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়নি। এমতবস্থায় বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে দ্রুত নির্বাচনী রোড ম্যাপ দাবি করা হলেও সরকার এ ব্যাপারে নিরব।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণের জন্য সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান এক থেকে দেড় বছর অর্থাৎ আঠার মাসের যে সময়সীমার কথা উল্লেখ করেছিলেন সেটিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব ‘ব্যক্তিগত মত’ উল্লেখ করা হয়। কারও কারও কাছে বিষয়টি নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সেনাপ্রধান ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে ‘ঐক্যমতের অভাব’-এর বহিঃপ্রকাশ’ বলে মনে হচ্ছে।
শুরুর দিকে বিএনপি সরকারকে সময় দেওয়ার কথা বললেও এখন নির্বাচন চাইছে, অন্তত নির্বাচন কবে হবে, সে বিষয়ে ঘোষণার দেওয়ার দাবিও জানাচ্ছেন নেতারা। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধানও নির্বাচন কবে হতে পারে, সে বিষয়ে আভাস দিয়েছিলেন। তিনি তখন বলেন, সংস্কারের মধ্য দিয়ে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে বাংলাদেশের ‘গণতন্ত্রে উত্তরণ’ ঘটা উচিত। তবে সেজন্য সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে।
এর মধ্যে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে চ্যানেল আইয়ের সংবাদ পর্যালোচনামূলক অনুষ্ঠান ‘আজকের সংবাদ’ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, রিয়েলিস্টিক্যালি আগামী বছরের মধ্যে (২০২৫) ইলেকশন করাটা হয়ত সম্ভব হতে পারে।’ সরকার ‘কিছুদিনের মধ্যেই’ সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেবে বলেও জানান তিনি। এরপর ভোটার তালিকা হালনাগাদ হবে, বলেন তিনি। যদিও শনিবার আইন উপদেষ্টা এ ব্যাপারে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেন, নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পলিসি ডিসিশন। এর সময় সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে ঠিক হবে। তিনিই একমাত্র এটা ঘোষণা দেওয়ার এখতিয়ার রাখেন।
অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন কবে দেবে? বড় হয়ে উঠা এই প্রশ্নের মধ্যে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ও আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাকে ‘ব্যক্তিগত বক্তব্য জানিয়েছেন ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন। তিনি বলেছেন, এই দুই জনের বক্তব্য সরকারের বক্তব্য নয়। শুক্রবার সন্ধ্যায় কক্সবাজারের হিলডাউন সার্কিট হাউজে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে ধর্ম উপদেষ্টা এ কথা বলেন। ধর্ম উপদেষ্টা বলেন, ‘একটি সরকারের পতন হয়েছে। সেই সরকারের অবশিষ্ট সময় পূরণের জন্যই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বসানো হয়েছে। তার চেয়ে বড় কথা রাষ্ট্র সংস্কার প্রসঙ্গ। সংস্কার না করে নির্বাচন দিলে রাষ্ট্র নড়বড়ই থেকে যাবে। তাই সরকার সংস্কারে গভীরভাবে কাজ করছে।’
ধর্ম উপদেষ্টা বলেন, ‘আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও সেনা প্রধানের বক্তব্য সরকারের বক্তব্য নয়। সরকার যতদিন নির্দিষ্ট করে বলবে না ততদিন নির্বাচনের সময় নির্ধারিত নয়।’
গত ৮ অগাস্ট সংবিধান সমুন্নত রাখার শপথ নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নিচ্ছে, তারা নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা ঘোষণা করেনি। সংবিধান অনুযায়ী সংসদ ভেঙে যাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে ভোটের কথা বলা আছে। দৈব দুর্বিপাকে সেটি করা না গেলে পরের ৯০ দিনের মধ্যে করতে হবে।
নির্বাচন নিয়ে সেনাপ্রধান ও সরকারের উপদেষ্টার মধ্যে ঐক্যমতের অভাব স্পষ্ট পরিলক্ষিত হচ্ছে। সূত্রের খবর, নির্বাচন নিয়ে সরকারের একটি পক্ষ চাইছে, ২০২৫ সালের মধ্যেই নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে, কিন্তু সরকারের দুজন তরুণ উপদেষ্টাসহ একটি অংশ এতে বাধা সেধেছে। তাদের মতে, একটি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সরকার গঠন হয়েছে। ছাত্র-জনতা রায়ে আমরা দেশ পরিচালনা করছি। দেশকে নতুন করে সাজিয়ে তবেই নির্বাচন। সেটি কতোদিন বা কতো বছর পর তা তারা এখনই ঘোষণা করতে নারাজ!
এতে সন্দেহ তৈরিহ হচ্ছে, সরকার কি তাহলে ৫ বছর ক্ষমতায় থাকতে চায়? বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছেন, বিতর্ক এড়াতে নির্বাচন নিয়ে বক্তব্য সরকারের দিক থেকেই আসা উচিত। এবং যতো দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিয়ে সরকার বিদায় নিক, নির্বাচন সরকারই দেশ এগিয়ে নেবে। অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় বেশি দিন থাকলে দেশ থমকে যাবে। অচলাবস্থা তৈরি হবে। সরকারের উচিত, স্পষ্টভাবে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা। তা না হলে সরকারের প্রতি মানুষ অনাস্থা জানাবে। যা তাদের জন্য সুখকর নাও হতেপারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, বেশিদিন ক্ষমতায় থাকলে মানুষ পছন্দক করবে না। চাপিয়ে রাখা বা লুকানোর প্রবণতা ভালো কিছুর ইংগিত নয়। সরকারের উচিত সবকিছু পরিষ্কার করা। তারা কতোদিন ক্ষমতায় থাকতে চান, কবে নির্বাচনে দেবেন, কী কী করতে চান। সরকার তার অবস্থান স্পষ্ট না করলে নেতিবাচক কিছু চিন্তা করলে মানুষকে তখন দোষ দেওয়া যাবে না বলেও মনে করেন তারা।