সিরাজ ইসলাম : ডেঙ্গু বা ডেঙ্গু জ্বর একজাতীয় ভাইরাল সংক্রমণ। তা মশা থেকে মানুষের মাঝে ছড়ায়। ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত এডিস মশার কামড়ে এটি মানবদেহে সঞ্চারিত হয়। সংক্রমণ দেখা যায় গ্রীষ্ম-ও উপগ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুতে। সাধারণত শহুরে বা আধা-শহুরে এলাকায়।
পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই এখন ডেঙ্গুর ক্রমবর্ধমান ঝুঁকিতে রয়েছে। এবং বিশ্ব জুড়ে প্রতি বছর আনুমানিক ১০ কোটি থেকে ৪০ কোটি সংক্রমণ ঘটে চলেছে।
ডেঙ্গুতে সংক্রামিত বেশিরভাগ মানুষই কোন উপসর্গ ছাড়াই এবং ডেঙ্গু ছিল তা না জেনেই স্বত:স্ফূর্তভাবে সেরে উঠবেন। উপসর্গ থাকলে সেগুলো সাধারণত হালকা থেকে মাঝারি হয় এবং সংক্রামক মশার কামড়ের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে প্রকাশ পায়।
লক্ষণগুলো মূলত ফ্লু ধরণের যা ছয় সাত দিন স্থায়ী হয়। প্রধান লক্ষণ হালকা থেকে মাঝারি জ্বর, মাথাব্যথা, চোখের পিছনে ব্যথা, পেশী ও সন্ধিতে ব্যথা এবং ত্বকে রক্তক্ষরণ জনিত লাল ফুসকুড়ি।
খারাপ ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে দুটো প্রধান প্রকট লক্ষণ মাত্রাতিরিক্ত জ্বর (৩৯.৫-৪০.৫ সে. বা ১০৩-১০৫ ফা.) এবং সারাদেহে তীব্র ব্যথা।
উপসর্গ-আক্রান্ত অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা বাড়িতেই করা যায়। ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে বা ডাক্তার ছাড়াই তা করা যায়। তবে ডেঙ্গুর গুরুতর প্রকার নির্দেশক নিম্নলিখিত সতর্কতা সংকেতগুলোর যেকোন একটি দেখা দিলে অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া জরুরি:
◘ পেটে ব্যথা (বর্ধিত লিভারের কারণে), বমি হওয়া (দৈনিক অন্তত তিনবার), রক্তক্ষরণ (ত্বকে লাল ফুসকুড়ি, নাক দিয়ে রক্ত, মাড়ি থেকে রক্ত, বমিতে রক্ত, মলে রক্ত) এবং প্রচণ্ড ক্লান্ত বোধ করা। ◘
ত্বকে লাল ফুসকুড়ি বা উপরোক্ত সতর্কতা সংকেতগুলোর অনুপস্থিতিতে মারাত্মক বা রক্তক্ষরী ডেঙ্গুর সম্ভাবনা খুব কম। অবশ্য এক্ষেত্রে সম্প্রতি কিছু এটিপিকাল প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
ডেঙ্গুর রোগনির্ণয় যেহেতু মূলত ল্যাবরেটরি-অনির্ভর ও ক্লিনিক্যাল, তাই উপসর্গ ও সতর্কতা লক্ষণগুলোর উপর নজর রাখাই প্রধানত প্রয়োজন।
অর্থাৎ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডেঙ্গুতে কোন ল্যাবরেটরি পরীক্ষা অত্যাবশ্যক না। তবে জেনে নেয়ার খাতিরে, ডেঙ্গুর বিশেষ সন্দেহ জাগানো রোগীদের ক্ষেত্রে প্লেটলেট বা অনুচক্রিকা সহ সম্পূর্ণ রক্তগণনা (FBC), Dengue NS1 এন্টিজেন, IgG এন্টিবডি এবং IgM এন্টিবডি পরীক্ষা করা উচিত। এছাড়াও CRP, LFT এবং creatinine পরীক্ষাগুলো উপকারী। যদিও ভাইরাসের বিশেষ পরীক্ষাটুকু ছাড়া প্লেটলেট সহ অন্যান্য পরীক্ষাগুলো সুনিশ্চিতভাবে রোগনির্ণয়ের পক্ষে তেমন সহায়ক না।
ডেঙ্গুর জন্য কোন নির্দিষ্ট এন্টিভাইরাল ওষুধ নেই। এবং অ্যাজিথ্রোমাইসিন বা অন্য কোন এন্টিবায়োটিকে কাজ হয়না।
ব্যবস্থাপত্র প্রধানত সাপোর্টিভ: উপসর্গ উপশম, হাইড্রেশন, শরীরকে আত্মনিরাময়ে সাহায্য করার জন্য পর্যাপ্ত শয্যা বিশ্রাম, এবং ত্বকের লাল ফুসকুড়ির মতো কোন বড় রক্তক্ষরণের প্রবণতা পর্যবেক্ষণ। এধরণের ক্ষেত্রে প্লেটলেটের ঘাটতি পূরণ সহ ইন্ট্রাভেনাস ফ্লুইডস নেয়ার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অপরিহার্য।
প্রচুর পরিমাণে তরলজাতীয় খাবার গ্রহণ ক’রে শরীরকে সজল রাখার মাধ্যমে রক্তের আয়তন বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। খানিক পরপর যেমন ডাবের পানি, ফলের রস, লেবুর শরবত, চা এবং খাবার স্যালাইন পান করা যায়।
জ্বর ও ব্যথা নিয়ন্ত্রণে প্যারাসিটামল বা প্যানাডল ভালো। তবে ডেঙ্গুতে অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন, ডাইক্লোফেনাক বা নেপ্রোক্সেন জাতীয় ওষুধ খাওয়া নিষেধ। এসব ওষুধ থেকে রক্তক্ষরণের আশংকা বেড়ে যায়। ওমেপ্রাজল পাকস্থলি ও অন্ত্রে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি কমায়। এবং ডেসলোরাটাডিন প্রভৃতি এন্টিহিস্টামিন যেকোন অ্যালার্জি বা ইমিউনোলজিক্যাল প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করে।
প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ভালো
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে ডেঙ্গুর ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া আমাদের দেশে অনেকটা অপরিকল্পিত নগরায়ন সহ বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশগত কারণ সাম্প্রতিককালে এডিস মশার ঘনত্ব ও ডেঙ্গু সংক্রমণের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে।
তবে এডিস মশা যেহেতু ডেঙ্গুর বাহক, তাই এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এছাড়া অন্যান্য মশার তুলনায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণও সহজ। কারণ এডিস মশা মূলত বর্জ্য বোতল, কৌটা ও পাত্র জাতীয় আধারে জমে থাকা বদ্ধপানিতে বংশবিস্তার করে। এধরণের বর্জ্য অপসারণ কঠিন কোন কাজ নয়। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও সহযোগিতা প্রয়োজন।
সূত্র : https://www.facebook.com/profile.php?id=100004958970280