নাদিম মাহমুদ : কলকাতায় উপহাইকমিশনের সামনে বাংলাদেশের পতাকা পোড়ানো, ঢাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গেইটে ভারতের পতাকায় কার্পেট বানানো; জাতিসংঘ ফোরামে বাংলাদেশ সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে উত্তপ্ত বক্তব্য গত চব্বিশ ঘণ্টায় ‘বাংলাদেশ-ভারতের’ সম্পর্কে এমন জায়গায় দ্বার করিয়েছে, যা স্বাধীনতার পর এমন পরিস্থিতি আদৌ হয়েছে কি না আমার জানা নেই।
অবস্থা এমন দিকে যাচ্ছে, আগামীতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক অনেকটাই ভারতের সাথে পাকিস্তান-চীনের যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে ঠিক সেই পর্যায়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালিন সরকারের বর্তমানে ভারতকেন্দ্রিক যে অবস্থান পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে আমি সাতচল্লিশের একটি আবহ অনুভব করতে পারছি, যা সত্যিই অস্বস্তিকর বটে। দেশের মানুষ যদি ঐক্যবদ্ধ না থাকে, তবে আগামীতে বাংলাদেশ অনেকটাই পোলারাইজড নেশনে পরিণত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। যে জাতি যত বিভাজিত হবে, সে জাতিকে দ্রুত পরাজিত করা সম্ভব হয়।
দৃশ্যত ইউনূস সরকার ভারতের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেও আশানুরুপ কোন ফল পায়নি। ক্রমাগত তথ্যের পাপাচারিতে ‘বাংলাদেশ’ এখন ভারতীয়দের কাছে ‘অগ্নিগর্ভ’। এই যাত্রা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।
নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে এইদেশের একটি বড় অংশই পছন্দ করত। শেখ হাসিনা সরকারের মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ ব্যতিত তার দলের লাখো সমর্থক ইউনূসকে সম্মান করত। কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের শুরুতে ই্উনূস সরকার নিজেই বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিতর্ক তৈরি করে একটা বিভাজনের রেখা টেনেছিলেন। তিনি হয়ত জানে না, এই ছাত্র-বিক্ষোভে হাজারো আওয়ামীলীগ ঘরোনার সন্তানরা কোটা বাতিলের জন্য আন্দোলন করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামীলীগ করে না এমন কোটি মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করে।
কিন্তু আমরা দেখলাম কি, তার সরকার মনে করেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে ভিলেন বানালে আওয়ামীলীগকে শায়েস্তা করা যাবে। ফলশ্রুতিতে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি মোছার কাজে ব্যস্ত ছিল একটি পক্ষ। যা একটি ভুল পদক্ষেপ এবং জাতিকে বিভাজিত করার রেখাটি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন।
আজ ভারত ইস্যূতে কেন্দ্র করে, দেশে ভিতর ও বাহিরে যে অস্থিরতা চলছে তা থেকে আমরা সহজে মুক্তি পাব না। রক্তাক্ত বিপ্লেবে যে পরিবর্তনের স্বপ্ন মানুষ দেখেছিল, তার ফল পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অন্তবর্তীকালিন সরকারের দূর্বলতা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ফলশ্রুতিতে সংস্কার কমিশনের সংস্কারের সুপারিশ ও তার বাস্তবায়ন আদৌও সম্ভব কি না জানি না। এখন দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করা সরকারের কাছে মঙ্গলজনক সমাধান। আবার এই নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক শক্তির হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিতে গেলেও আওয়ামীলীগ নিয়ে সরকারের যে অবস্থান তাতে ‘আওয়ামীলীগ ছাড়ায়’ আগামীতে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার সম্ভবনা প্রকট। আর এই নির্বাচন হলেও সেটা কতটা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে তা নিয়ে দেশের বাহিরে প্রশ্ন থাকবে। কারণ, এই দেশের এখনো ৩০ শতাংশ মানুষ আওয়ামীলীগের মতাদর্শের। এই জনগোষ্ঠিকে বাহিরে রেখে যে নির্বাচন হবে তা আগামীর সরকারকে বেশ ভোগাবে।
এই রকম সমস্যার উপর দাঁড়িয়ে অন্তবর্তীকালিন সরকার চিন্ময় প্রভুর ই্স্যূতে ভারত-বিদ্বেষ আগামীর বাংলাদেশ সংকটময় থেকে কর্ণ্টকময় হয়ে যাচ্ছে। উত্তেজনা প্রশমন না হলে তেপান্নো বছরের অর্জন ম্লান হতে বাধ্য।
আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মানুষ খেতে পারছে, নাকি মরছে, এদেশে গণতন্ত্র আছে না মরে যাচ্ছে এটা ভারতের আলোচনার বিষয় নয়। সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশটি যে আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করছে, সেটা মূলত সাতচল্লিশের দেশভাগেরই আবহকেন্দ্রিক উন্মদনা। সুতরাং ধর্মকে সামনে রেখে দুই দেশের এই বিভাজন রেখা আমাদের স্বস্তির কারণ হয়ে উঠবে না। আমরা চাই শান্তি। এই শান্তি ঠিক কীভাবে আসবে, তা নিয়ে ভাবতে হবে। জাতির এই সংকটকালিন সময়ে আমাদের ঐক্যবদ্ধ না হলে ঈশান কোণের কালো মেঘ আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। বাঙালি দুর্মর জাতি, আমাদের একতা আমাদের আগামী দিনের চলার শক্তি। আর কোন বিভাজন রেখা টানি না, সবাইকে নিয়ে দেশটাকে এগিয়ে নিই। ফেসবুক থেকে